শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

আর কতকাল কালো টাকা!



॥ আবু আহমেদ ॥

আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকা কিছু ট্যাক্স দিয়ে সাদা করা একটা চলমান সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যতই আমরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে বলি না কেন, বাজেট উপস্থাপন কালে অথবা অর্থ বিলে এই কালোকে সাদা করার পক্ষে কিছু দুর্বল যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী সেই সুযোগকে অব্যাহত রাখার পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ধরনের সুযোগ অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ না কমিয়ে বরং এর উৎসগুলোকে আরো জোরদার করবে। এই সুযোগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কালো টাকার কালো ব্যবহার কখনো কমানো যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। কালো টাকার উৎস কী? বেআইনি লেনদেন, ঘুষ-দুর্নীতি, কমিশন ও দালালি। এসব আয়ের আইনি ভিত্তি নেই; থাকলেও তা অতি দুর্বল। একজন চোরাকারবারি এমনিতেই বেআইনি কাজে লিপ্ত, যদি তার কথিত আয়কে সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বৈধতা দেয়া হয়, তাহলে সমাজে কি চোরাকারবার কমবে? অনেকে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে চোরাই পথে দেশের বাইরে পাঠিয়ে আবার সেই অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে এনে কথিত বিনিয়োগে দেখাচ্ছে, নতুবা সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বা কোনো রকম ট্যাক্স না দিয়েই সেই পাচারকৃত অবৈধ অর্থকে বৈধ আয় হিসেবে দেখাতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উচিত, বিদেশ থেকে আগত অর্থের উৎস তলিয়ে দেখা। ওই অর্থ যদি বিদেশে অর্জিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় ট্যাক্স-ফ্রি হিসাবে বাংলাদেশে ফিরে এসে বিনিয়োগ হিসেবে প্রদর্শিত হবে! এটা ঠিক, অর্থের কোনো সীমানা নেই। বাংলাদেশের ধনীরা এখন অর্থ নিয়ে বিপদে আছেন। তারা বাংলাদেশকে বিনিয়োগ আয়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা মনে করলেও এই দেশকে অর্থ সঞ্চয় করার জন্য নিরাপদ ভাবেন না। ফলে বাংলাদেশে ব্যবসায়িক লাভ অন্য অনেক দেশ থেকে বেশি হলেও সব আয় বাংলাদেশে থাকে না। বাংলাদেশে যদি এ দেশের সব আয় থাকতো তাহলে আমাদের অর্থনীতি বিনিয়োগের জন্য অর্থের অভাবে ভুগত না। অনেকে আবার ঘুষ দেয়াসহ নানা হয়রানির ভয়ে তাদের ব্যবসায়কে এখানে বড় করতে চাচ্ছেন না। তারা ব্যবসায় সম্প্রসারণ করে দুর্নীতির শিকলে আটকা পড়তে চান না। ফলে বাংলাদেশে এখন যে ব্যবসায় হচ্ছে, তা হলো কিছু ধনিকের ব্যবসায় যারা নিছক ব্যবসায়ের খাতিরে সরকারের সাথে অন্তরঙ্গতা বজায় রাখেন। একেবারে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত, বড় ব্যবসায় দেখা যায় না বললেই চলে। সে অর্থে ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। জিজ্ঞেস করলে তারা বলবেন ‘কী করব ভাই, করাপশন চেইনের সাথে সখ্য না রাখলে যে, ব্যবসায়ই করা যাবে না।’ এরা বলেন আমরা করাপশন চেইনকে খুশি রাখি আর সেটা উন্মুক্ত করতে নিজেরাও করাপশন করি। 
বাংলাদেশ থেকে যে কত অর্থ বিদেশে যাচ্ছে, তার আনুমানিক হিসাব পাওয়া যেত বাইরে বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন সম্পদের হিসাব নিতে পারলে। আজকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বাংলাদেশীরা যেসব সম্পদের মালিক, তার পেছনে ব্যয়কৃত অর্থের উৎস কী? সেই জন্য বলি, বাংলাদেশী ধনীদের অনেকেই এখন গ্লোবাল সিটিজেন। তাদের একাধিক পাসপোর্টও আছে। সময়ের বেশির ভাগ তারা পার করেন দেশে নয়, বিদেশে। তাদের দোষ দেয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশের সমাজ-পরিবেশ-রাজনীতি তাদের দেশের বাইরে নিরাপত্তা খুঁজতে বাধ্য করেছে।
কালো টাকার উৎস শত ভাগ বন্ধ করা যাবে, তা বলি না। তবে কালো টাকা, যে টাকার উৎস হয় কালো আয়, অথবা আয় বৈধ কিন্তু ট্যাক্স দেয়া হয়নি, অর্থনীতিতে বেশি থেকে আরো বেশি করে এটা সৃষ্টি হতে থাকবে, যদি কালো টাকা ধরার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ নেয়। সাদা করার সুযোগ দিয়ে কোনো অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ কমানো যায়নি। বাংলাদেশ তো গত এক যুগ বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে, কিন্তু এই অর্থের পরিমাণ কমেছে কি? না। কেন কমেনি? কমেনি এই জন্যই যে, ৭.৫-১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়েও কালো টাকার ধনী লোকেরা তাদের অর্থকে সাদা করতে রাজি নন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা কালো টাকা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন। অথচ তাদের থেকে বেশি চিন্তিত আমাদের রাজস্ব বোর্ড। ধরপাকড় না থাকলে কালো টাকার মালিকেরা ১০ শতাংশ ট্যাক্স দেবেন কেন?
আমাদের অবস্থান এ বিষয়ে পরিষ্কার। কালো টাকা ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে সাদা করার বিধান শুধু দুর্নীতিকেই বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় ও অবিচার। তারা কর দিচ্ছেন ২৫ শতাংশ হারে অথচ যারা অপরাধ করেছেন, দুর্নীতি কিংবা আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেসব অসৎ লোককে কেন মাত্র ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে টাকাকে বৈধ করতে দেয়া হবে? একটা সহজ উদাহরণ হলো, ১০ কোটি কালো টাকা সাদা করতে ট্যাক্স দিতে হবে ১০-১৫ লাখ টাকা। আর সৎ ব্যবসায়ী বা ভালো মানুষ ওই পরিমাণ টাকার বিপরীতে ট্যাক্স দিচ্ছেন ২২-২৫ লাখ টাকা। এটা কি ন্যায়সঙ্গত হলো? আমাদের প্রস্তাবÑ এক. কালো টাকার উৎস সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হোক। আয়টা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। দুই. বৈধ আয় হলে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স এবং তার সাথে জরিমানা সাদা করার সেই সুযোগ দেয়া হোক।
কিন্তু কথিত বিনিয়োগের নামে কালো টাকাকে ট্যাক্স ফ্রি করে দিলে সেটাও বড় অন্যায় হবে।
সমাজে ন্যায়বিচার চলে গেলে সৎ মানুষেরাও অসৎ পথে হাঁটতে চেষ্টা করেন, নতুবা নিজেদের গুটিয়ে-সুটিয়ে নেন। সরকার কি কালো টাকাকে বৈধতা দেয়ার নামে সৎ লোকদের প্রতি চরম অন্যায় করছে না?
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রবিবার, ৩ জুন, ২০১২

বাংলাদেশ অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়ছে যে কারণে

আমাদের অর্থনীতিটা উঠতে গিয়েও উঠতে পারছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনীতি পেছনে চলে যাচ্ছে। গত তিন বছর অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। মানুষের প্রকৃত আয় তথা ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তিন বছরে যদি মোট ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ঘটে, তাহলে এটা বলা যায় একজন স্থির আয়ের মানুষ আগের তুলনায় ৩৬ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে। এ অবস্থায় সমূহবিপদে পড়েছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষগুলো। আজকে সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতির গতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু ওই গতি হ্রাস কি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমার কারণে ঘটছে, না সরকারের মূল্যস্ফীতিবিরোধী নীতিমালার জন্য ঘটছে- সেটা ভেবে দেখা দরকার। সরকার এমন কোনো বড় নীতি গ্রহণ করেনি, যার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তারা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে; বরং সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আয়কে কেড়ে নিচ্ছে এবং অর্থনীতিতে একটা মন্দাবস্থার সৃষ্টি করেছে। সেটা কিভাবে এরই একটু বিশ্লেষণ দিচ্ছি।
এক. অর্থনীতি যদি ভালো থাকত তাহলে তো অর্থমন্ত্রীর গত বাজেট বক্তৃতায় যে বলেছিলেন, জাতীয় প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি বাড়বে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ শতাংশ করে। সেই অর্জন কি বছর শেষে অর্জিত হচ্ছে? বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধি বড় জোর ৬ শতাংশ হতে পারে, আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বলছে, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে ৭ এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে পার্থক্য কত, কত হাজার কোটি টাকার সেবা ও পণ্য এই অর্থনীতিতে কম উৎপাদিত হয়েছে? অন্য প্রশ্নটি হলো, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ একযুগের মধ্যে এই অর্থনীতিতে সর্বনিম্ন অর্জন। আর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন করার জন্য সরকারের কোনো পলিসি সাপোর্ট দরকার আছে বলে কোনো অর্থনীতিবিদই মনে করেন না।
দুই. আমাদের অর্থনীতি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারল না কেন? মোটা দাগে উত্তর হলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ হলে অর্থনীতি ৭ শতাংশ হিসাবে বাড়তে পারত, সেই পরিমাণ বিনিয়োগ অর্থনীতি পাইনি। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির কমপক্ষে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। বাংলাদেশে অর্থনীতিতে কি সেই পরিমাণ বিনিয়োগ বেড়েছে? বাস্তবতা হলো এই অর্থনীতি ২০-২২ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ পাইনি; বরং আরো কম পেয়েছে।
তিন. কেন অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পেল না- সে ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আগ থেকেই ছিল, তবে সেসব সমস্যার সমাধান করার জন্যই তো জনগণ এই সরকারকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু মুখ্য কারণ হলো, আমার মতে সরকারের কিছু ভুল পলিসি। ভুল পলিসির মধ্যে অন্যতম হলো বিনিয়োগবিরোধী বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি। লক্ষ করবেন, জুন ২০১০ পর্যন্ত এই অর্থনীতি মোটামুটি সঠিক পথেই এগোচ্ছিল। মূল্যস্ফীতি সহনীয় ছিল। আমাদের মুদ্রা টাকাও ডলারের বিপরীতে ভালো মান বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছিল। অর্থনীতিতে সুদের হার কম ছিল। চারদিকে বিনিয়োগ তহবিলের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু ২০১০ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের শিখিয়ে দেওয়া ছকে যখন নতুন মুদ্রানীতি গ্রহণ করল, তখন থেকেই অর্থনীতিতে তারল্য সংকট দেখা দিল। সুদের হার দ্বিগুণ হলো। বিনিয়োগের জন্য তহবিলের টানাটানি শুরু হলো। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক কাজ-কারবারকে বৃদ্ধি করার জন্য নতুন করে তহবিল পেল না। তাদের ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে গেল। বিনিয়োগে ধস নামল। যার ফল হলো আজকের দিনে মন্দা এবং কম প্রবৃদ্ধির বৃত্তে অর্থনীতিকে বেঁধে ফেলা। আজও সেই একই মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসরণ করে চলেছে। ফল হচ্ছে সেই একই- কম বিনিয়োগ, কম উৎপাদন এবং কম প্রবৃদ্ধি অর্জন। একটা চলমান অর্থনীতিকে একটা ভুল মুদ্রানীতি যে কিভাবে পেছনে ঠেলে দিতে পারে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু দুঃখ হলো, সরকার এই ভুল পলিসি থেকে উঠে আসার কোনো চেষ্টাই করেনি; বরং একনিষ্ঠভাবে আইএমএফ যে শর্ত দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলোই পরম উপজীব্য ভেবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কারণ কী? কারণ কিছুটা অজ্ঞতা, কিছুটা আইএমএফের সেই এক বিলিয়ন ডলারের ইসিএফ (ECF) ঋণ। ঋণ বেচতে চাইলে আইএমএফ আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক শর্তই দেবে। কিন্তু বিনিয়োগবিরোধী ওই সব শর্ত মেনে কোনো বোদ্ধা সরকার কি ঋণ নিতে পারে? সত্য হলো, আমাদের সরকার সেই এক বিলিয়ন ডলারের ঋণটা পাওয়ার জন্য বড়ই পেরেশান। এরই ফল হলো আজকের অর্থনীতিতে বন্ধ্যত্ব।
চার. কেউ কি কোনো দিন শুনছে, প্রবৃদ্ধি কমে গেলে সেই অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কমে? কিন্তু সরকার তো তা-ই বলছে! সত্য হলো, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমার কারণে মানুষের ভোগ ব্যয় কমে গেছে। যে অর্থনীতি কম ব্যয়ে প্রবেশ করে, সেই অর্থনীতি শুধু পেছনেই যেতে থাকে। অর্থনীতিকে পেছনে ঠেলে দিয়ে যে মূল্যস্ফীতি কমার কথা বলা হচ্ছে, তা অর্থনীতির জন্য কি ভালো? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির সোনালি দিনগুলোকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি।
পাঁচ. অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক ময়দানে। ভীতিকর একটা অবস্থার মধ্যে বিনিয়োগ তো হবেই না বরং অর্থনীতি থেকে আয় বিদেশে উড়াল দেবে। কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন পথে বাইরে চলে গেছে। এখন বাংলাদেশের ধনীরা নিজ দেশকে আয় ধারণের জন্য নিরাপদ মনে করছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হলো কেন? এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বরং চোখের সামনে যেটা দেখছি, সেটা হলো আমাদের এই প্রিয় দেশ একটা ভীতিকর অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এটাই আজকে বোদ্ধা সমাজকে বারবার ভাবিয়ে তুলছে। রাজনীতি যদি অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়, সেই অর্থনীতিতে আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তখন যেটা বেচে থাকে, সেটা হলো চাঁদাবাজি, চোরাকারবারী এবং রেন্ট সিকিং (Rent Seeking)। এ ধরনের অর্থনীতিতে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু থাকে না। সাধারণ জনগণ দুষ্টপথে উপার্জিত অর্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। অনেকের অবস্থা অনেকটা তা-ই। সেই অবস্থা ভাঙার জন্য অথবা আমাদের ভুলনীতির সৃষ্ট কম আয়ের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার কোনো উদ্যোগ আছে কি?
ছয়. সরকারি ঋণ যে হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই অর্থনীতি একটি বড় দুর্যোগের সম্মুখীন হবে। সরকারি ঋণের তিনটি বড় খারাপ দিক আছে। প্রথমত. এই ঋণ জমা হতে হতে একদিন বহন করার ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ চলে যাবে অতীতের ঋণের দায় মেটাতে। তখন কি কোনো অর্থমন্ত্রী আদৌ বাজেট মেলাতে পারবেন? পারবেন বড় থেকে বড় অঙ্কের পুনঃঋণ করে। এর অর্থ হবে অর্থনীতি ঋণের এক দুষ্টচক্রে প্রবেশ করবে। অথচ আর্থিক শৃঙ্খলার বিষয়টি কেমন হবে। দ্বিতীয়ত. তখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, শুধু মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করেই অবস্থার সামাল দিতে বাধ্য হবে। এ জন্য উপদেশ হলো সামর্থ্যের মধ্যে চলুন। ঋণ করে ঘি খাওয়ার দরকার নেই। সময় থাকতে ঘাটতি বাজেটের রশি টেনে ধরুন।
সাত. রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ছোট বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে অতিরিক্ত ২০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি টানতে হচ্ছে। ক্রমে সেই অতি মূল্যের বিদ্যুৎকে জনগণকে বলা হবে তোমরা পূর্ণ মূল্য দিয়ে কেনো। জনগণ বিদ্যুৎ চাইছে। তবে নিশ্চয়ই অতি মূল্যের এই বিদ্যুৎ নয়। আজকে বিদ্যুৎ খাতকে কেন্দ্র করে Rent Seeking যেমন হচ্ছে, তেমনি অন্য দুর্নীতি অর্থনীতিকে গ্রাস করতে চলেছে। অনুরোধ থাকবে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের এই সর্বনাশা পদ্ধতি থেকে ফিরে আসুন। যে বোঝা ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে অর্থনীতির ওপর চাপানো হয়েছে, সে বোঝা অর্থনীতির বহনের কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা আছে তার মূল্য দিতে হবে দরিদ্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তাদের।
শেষ কথা হলো, অর্থনীতিতে যেসব আপদ আজকে জেঁকে বসেছে তার বেশির ভাগই সরকারের ভুল পলিসিরই ফল। অর্থনীতিতে একটা অনাস্থা ও হতাশার ভাব বিরাজ করছে। ভোক্তা দুঃখে আছে, বিনিয়োগকারী দুঃখে আছে, শেয়ারবাজারের লোকজন দুঃখে আছে, সৎ লোকজন দুঃখে আছে। তাহলে এই অর্থনীতিতে কে সুখে আছে?

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়