শনিবার, ৯ জুন, ২০১২

আর কতকাল কালো টাকা!



॥ আবু আহমেদ ॥

আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকা কিছু ট্যাক্স দিয়ে সাদা করা একটা চলমান সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যতই আমরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে বলি না কেন, বাজেট উপস্থাপন কালে অথবা অর্থ বিলে এই কালোকে সাদা করার পক্ষে কিছু দুর্বল যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী সেই সুযোগকে অব্যাহত রাখার পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ধরনের সুযোগ অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ না কমিয়ে বরং এর উৎসগুলোকে আরো জোরদার করবে। এই সুযোগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কালো টাকার কালো ব্যবহার কখনো কমানো যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। কালো টাকার উৎস কী? বেআইনি লেনদেন, ঘুষ-দুর্নীতি, কমিশন ও দালালি। এসব আয়ের আইনি ভিত্তি নেই; থাকলেও তা অতি দুর্বল। একজন চোরাকারবারি এমনিতেই বেআইনি কাজে লিপ্ত, যদি তার কথিত আয়কে সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বৈধতা দেয়া হয়, তাহলে সমাজে কি চোরাকারবার কমবে? অনেকে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে চোরাই পথে দেশের বাইরে পাঠিয়ে আবার সেই অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে এনে কথিত বিনিয়োগে দেখাচ্ছে, নতুবা সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বা কোনো রকম ট্যাক্স না দিয়েই সেই পাচারকৃত অবৈধ অর্থকে বৈধ আয় হিসেবে দেখাতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উচিত, বিদেশ থেকে আগত অর্থের উৎস তলিয়ে দেখা। ওই অর্থ যদি বিদেশে অর্জিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় ট্যাক্স-ফ্রি হিসাবে বাংলাদেশে ফিরে এসে বিনিয়োগ হিসেবে প্রদর্শিত হবে! এটা ঠিক, অর্থের কোনো সীমানা নেই। বাংলাদেশের ধনীরা এখন অর্থ নিয়ে বিপদে আছেন। তারা বাংলাদেশকে বিনিয়োগ আয়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা মনে করলেও এই দেশকে অর্থ সঞ্চয় করার জন্য নিরাপদ ভাবেন না। ফলে বাংলাদেশে ব্যবসায়িক লাভ অন্য অনেক দেশ থেকে বেশি হলেও সব আয় বাংলাদেশে থাকে না। বাংলাদেশে যদি এ দেশের সব আয় থাকতো তাহলে আমাদের অর্থনীতি বিনিয়োগের জন্য অর্থের অভাবে ভুগত না। অনেকে আবার ঘুষ দেয়াসহ নানা হয়রানির ভয়ে তাদের ব্যবসায়কে এখানে বড় করতে চাচ্ছেন না। তারা ব্যবসায় সম্প্রসারণ করে দুর্নীতির শিকলে আটকা পড়তে চান না। ফলে বাংলাদেশে এখন যে ব্যবসায় হচ্ছে, তা হলো কিছু ধনিকের ব্যবসায় যারা নিছক ব্যবসায়ের খাতিরে সরকারের সাথে অন্তরঙ্গতা বজায় রাখেন। একেবারে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত, বড় ব্যবসায় দেখা যায় না বললেই চলে। সে অর্থে ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। জিজ্ঞেস করলে তারা বলবেন ‘কী করব ভাই, করাপশন চেইনের সাথে সখ্য না রাখলে যে, ব্যবসায়ই করা যাবে না।’ এরা বলেন আমরা করাপশন চেইনকে খুশি রাখি আর সেটা উন্মুক্ত করতে নিজেরাও করাপশন করি। 
বাংলাদেশ থেকে যে কত অর্থ বিদেশে যাচ্ছে, তার আনুমানিক হিসাব পাওয়া যেত বাইরে বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন সম্পদের হিসাব নিতে পারলে। আজকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বাংলাদেশীরা যেসব সম্পদের মালিক, তার পেছনে ব্যয়কৃত অর্থের উৎস কী? সেই জন্য বলি, বাংলাদেশী ধনীদের অনেকেই এখন গ্লোবাল সিটিজেন। তাদের একাধিক পাসপোর্টও আছে। সময়ের বেশির ভাগ তারা পার করেন দেশে নয়, বিদেশে। তাদের দোষ দেয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশের সমাজ-পরিবেশ-রাজনীতি তাদের দেশের বাইরে নিরাপত্তা খুঁজতে বাধ্য করেছে।
কালো টাকার উৎস শত ভাগ বন্ধ করা যাবে, তা বলি না। তবে কালো টাকা, যে টাকার উৎস হয় কালো আয়, অথবা আয় বৈধ কিন্তু ট্যাক্স দেয়া হয়নি, অর্থনীতিতে বেশি থেকে আরো বেশি করে এটা সৃষ্টি হতে থাকবে, যদি কালো টাকা ধরার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ নেয়। সাদা করার সুযোগ দিয়ে কোনো অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ কমানো যায়নি। বাংলাদেশ তো গত এক যুগ বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে, কিন্তু এই অর্থের পরিমাণ কমেছে কি? না। কেন কমেনি? কমেনি এই জন্যই যে, ৭.৫-১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়েও কালো টাকার ধনী লোকেরা তাদের অর্থকে সাদা করতে রাজি নন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা কালো টাকা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন। অথচ তাদের থেকে বেশি চিন্তিত আমাদের রাজস্ব বোর্ড। ধরপাকড় না থাকলে কালো টাকার মালিকেরা ১০ শতাংশ ট্যাক্স দেবেন কেন?
আমাদের অবস্থান এ বিষয়ে পরিষ্কার। কালো টাকা ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে সাদা করার বিধান শুধু দুর্নীতিকেই বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় ও অবিচার। তারা কর দিচ্ছেন ২৫ শতাংশ হারে অথচ যারা অপরাধ করেছেন, দুর্নীতি কিংবা আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেসব অসৎ লোককে কেন মাত্র ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে টাকাকে বৈধ করতে দেয়া হবে? একটা সহজ উদাহরণ হলো, ১০ কোটি কালো টাকা সাদা করতে ট্যাক্স দিতে হবে ১০-১৫ লাখ টাকা। আর সৎ ব্যবসায়ী বা ভালো মানুষ ওই পরিমাণ টাকার বিপরীতে ট্যাক্স দিচ্ছেন ২২-২৫ লাখ টাকা। এটা কি ন্যায়সঙ্গত হলো? আমাদের প্রস্তাবÑ এক. কালো টাকার উৎস সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হোক। আয়টা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। দুই. বৈধ আয় হলে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স এবং তার সাথে জরিমানা সাদা করার সেই সুযোগ দেয়া হোক।
কিন্তু কথিত বিনিয়োগের নামে কালো টাকাকে ট্যাক্স ফ্রি করে দিলে সেটাও বড় অন্যায় হবে।
সমাজে ন্যায়বিচার চলে গেলে সৎ মানুষেরাও অসৎ পথে হাঁটতে চেষ্টা করেন, নতুবা নিজেদের গুটিয়ে-সুটিয়ে নেন। সরকার কি কালো টাকাকে বৈধতা দেয়ার নামে সৎ লোকদের প্রতি চরম অন্যায় করছে না?
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রবিবার, ৩ জুন, ২০১২

বাংলাদেশ অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়ছে যে কারণে

আমাদের অর্থনীতিটা উঠতে গিয়েও উঠতে পারছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্থনীতি পেছনে চলে যাচ্ছে। গত তিন বছর অব্যাহতভাবে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। মানুষের প্রকৃত আয় তথা ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেছে। তিন বছরে যদি মোট ৩৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি ঘটে, তাহলে এটা বলা যায় একজন স্থির আয়ের মানুষ আগের তুলনায় ৩৬ শতাংশ দরিদ্র হয়েছে। এ অবস্থায় সমূহবিপদে পড়েছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষগুলো। আজকে সরকার বলছে, মূল্যস্ফীতির গতি কিছুটা কমেছে। কিন্তু ওই গতি হ্রাস কি জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমার কারণে ঘটছে, না সরকারের মূল্যস্ফীতিবিরোধী নীতিমালার জন্য ঘটছে- সেটা ভেবে দেখা দরকার। সরকার এমন কোনো বড় নীতি গ্রহণ করেনি, যার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তারা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারে; বরং সরকারের অর্থনৈতিক নীতিমালা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আয়কে কেড়ে নিচ্ছে এবং অর্থনীতিতে একটা মন্দাবস্থার সৃষ্টি করেছে। সেটা কিভাবে এরই একটু বিশ্লেষণ দিচ্ছি।
এক. অর্থনীতি যদি ভালো থাকত তাহলে তো অর্থমন্ত্রীর গত বাজেট বক্তৃতায় যে বলেছিলেন, জাতীয় প্রবৃদ্ধি তথা জিডিপি বাড়বে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ শতাংশ করে। সেই অর্জন কি বছর শেষে অর্জিত হচ্ছে? বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধি বড় জোর ৬ শতাংশ হতে পারে, আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বলছে, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি হবে না। যদি তা-ই হয়, তাহলে ৭ এবং ৫ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে পার্থক্য কত, কত হাজার কোটি টাকার সেবা ও পণ্য এই অর্থনীতিতে কম উৎপাদিত হয়েছে? অন্য প্রশ্নটি হলো, ৫ দশমিক ৫ শতাংশ একযুগের মধ্যে এই অর্থনীতিতে সর্বনিম্ন অর্জন। আর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ অর্জন করার জন্য সরকারের কোনো পলিসি সাপোর্ট দরকার আছে বলে কোনো অর্থনীতিবিদই মনে করেন না।
দুই. আমাদের অর্থনীতি ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারল না কেন? মোটা দাগে উত্তর হলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ হলে অর্থনীতি ৭ শতাংশ হিসাবে বাড়তে পারত, সেই পরিমাণ বিনিয়োগ অর্থনীতি পাইনি। ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির জন্য জিডিপির কমপক্ষে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। বাংলাদেশে অর্থনীতিতে কি সেই পরিমাণ বিনিয়োগ বেড়েছে? বাস্তবতা হলো এই অর্থনীতি ২০-২২ শতাংশের বেশি বিনিয়োগ পাইনি; বরং আরো কম পেয়েছে।
তিন. কেন অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ পেল না- সে ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আগ থেকেই ছিল, তবে সেসব সমস্যার সমাধান করার জন্যই তো জনগণ এই সরকারকে ভোট দিয়েছে। কিন্তু মুখ্য কারণ হলো, আমার মতে সরকারের কিছু ভুল পলিসি। ভুল পলিসির মধ্যে অন্যতম হলো বিনিয়োগবিরোধী বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি। লক্ষ করবেন, জুন ২০১০ পর্যন্ত এই অর্থনীতি মোটামুটি সঠিক পথেই এগোচ্ছিল। মূল্যস্ফীতি সহনীয় ছিল। আমাদের মুদ্রা টাকাও ডলারের বিপরীতে ভালো মান বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছিল। অর্থনীতিতে সুদের হার কম ছিল। চারদিকে বিনিয়োগ তহবিলের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু ২০১০ সালের জুলাই থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের শিখিয়ে দেওয়া ছকে যখন নতুন মুদ্রানীতি গ্রহণ করল, তখন থেকেই অর্থনীতিতে তারল্য সংকট দেখা দিল। সুদের হার দ্বিগুণ হলো। বিনিয়োগের জন্য তহবিলের টানাটানি শুরু হলো। ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা অর্থনৈতিক কাজ-কারবারকে বৃদ্ধি করার জন্য নতুন করে তহবিল পেল না। তাদের ব্যবসায়িক ব্যয় বেড়ে গেল। বিনিয়োগে ধস নামল। যার ফল হলো আজকের দিনে মন্দা এবং কম প্রবৃদ্ধির বৃত্তে অর্থনীতিকে বেঁধে ফেলা। আজও সেই একই মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংক অনুসরণ করে চলেছে। ফল হচ্ছে সেই একই- কম বিনিয়োগ, কম উৎপাদন এবং কম প্রবৃদ্ধি অর্জন। একটা চলমান অর্থনীতিকে একটা ভুল মুদ্রানীতি যে কিভাবে পেছনে ঠেলে দিতে পারে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু দুঃখ হলো, সরকার এই ভুল পলিসি থেকে উঠে আসার কোনো চেষ্টাই করেনি; বরং একনিষ্ঠভাবে আইএমএফ যে শর্ত দিয়ে যাচ্ছে, সেগুলোই পরম উপজীব্য ভেবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কারণ কী? কারণ কিছুটা অজ্ঞতা, কিছুটা আইএমএফের সেই এক বিলিয়ন ডলারের ইসিএফ (ECF) ঋণ। ঋণ বেচতে চাইলে আইএমএফ আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেক শর্তই দেবে। কিন্তু বিনিয়োগবিরোধী ওই সব শর্ত মেনে কোনো বোদ্ধা সরকার কি ঋণ নিতে পারে? সত্য হলো, আমাদের সরকার সেই এক বিলিয়ন ডলারের ঋণটা পাওয়ার জন্য বড়ই পেরেশান। এরই ফল হলো আজকের অর্থনীতিতে বন্ধ্যত্ব।
চার. কেউ কি কোনো দিন শুনছে, প্রবৃদ্ধি কমে গেলে সেই অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কমে? কিন্তু সরকার তো তা-ই বলছে! সত্য হলো, বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমার কারণে মানুষের ভোগ ব্যয় কমে গেছে। যে অর্থনীতি কম ব্যয়ে প্রবেশ করে, সেই অর্থনীতি শুধু পেছনেই যেতে থাকে। অর্থনীতিকে পেছনে ঠেলে দিয়ে যে মূল্যস্ফীতি কমার কথা বলা হচ্ছে, তা অর্থনীতির জন্য কি ভালো? অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির সোনালি দিনগুলোকে আমরা পেছনে ফেলে এসেছি।
পাঁচ. অর্থনীতিতে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক ময়দানে। ভীতিকর একটা অবস্থার মধ্যে বিনিয়োগ তো হবেই না বরং অর্থনীতি থেকে আয় বিদেশে উড়াল দেবে। কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন পথে বাইরে চলে গেছে। এখন বাংলাদেশের ধনীরা নিজ দেশকে আয় ধারণের জন্য নিরাপদ মনে করছেন না। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হলো কেন? এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বরং চোখের সামনে যেটা দেখছি, সেটা হলো আমাদের এই প্রিয় দেশ একটা ভীতিকর অবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এটাই আজকে বোদ্ধা সমাজকে বারবার ভাবিয়ে তুলছে। রাজনীতি যদি অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়, সেই অর্থনীতিতে আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। তখন যেটা বেচে থাকে, সেটা হলো চাঁদাবাজি, চোরাকারবারী এবং রেন্ট সিকিং (Rent Seeking)। এ ধরনের অর্থনীতিতে আইনশৃঙ্খলা বলতে কিছু থাকে না। সাধারণ জনগণ দুষ্টপথে উপার্জিত অর্থের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। অনেকের অবস্থা অনেকটা তা-ই। সেই অবস্থা ভাঙার জন্য অথবা আমাদের ভুলনীতির সৃষ্ট কম আয়ের বৃত্ত থেকে বের হওয়ার কোনো উদ্যোগ আছে কি?
ছয়. সরকারি ঋণ যে হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে এই অর্থনীতি একটি বড় দুর্যোগের সম্মুখীন হবে। সরকারি ঋণের তিনটি বড় খারাপ দিক আছে। প্রথমত. এই ঋণ জমা হতে হতে একদিন বহন করার ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশের রাজস্ব বাজেটের এক-তৃতীয়াংশ চলে যাবে অতীতের ঋণের দায় মেটাতে। তখন কি কোনো অর্থমন্ত্রী আদৌ বাজেট মেলাতে পারবেন? পারবেন বড় থেকে বড় অঙ্কের পুনঃঋণ করে। এর অর্থ হবে অর্থনীতি ঋণের এক দুষ্টচক্রে প্রবেশ করবে। অথচ আর্থিক শৃঙ্খলার বিষয়টি কেমন হবে। দ্বিতীয়ত. তখন যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, শুধু মূল্যস্ফীতি সৃষ্টি করেই অবস্থার সামাল দিতে বাধ্য হবে। এ জন্য উপদেশ হলো সামর্থ্যের মধ্যে চলুন। ঋণ করে ঘি খাওয়ার দরকার নেই। সময় থাকতে ঘাটতি বাজেটের রশি টেনে ধরুন।
সাত. রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের ছোট বিদ্যুৎ প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ কিনতে সরকারকে অতিরিক্ত ২০ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি টানতে হচ্ছে। ক্রমে সেই অতি মূল্যের বিদ্যুৎকে জনগণকে বলা হবে তোমরা পূর্ণ মূল্য দিয়ে কেনো। জনগণ বিদ্যুৎ চাইছে। তবে নিশ্চয়ই অতি মূল্যের এই বিদ্যুৎ নয়। আজকে বিদ্যুৎ খাতকে কেন্দ্র করে Rent Seeking যেমন হচ্ছে, তেমনি অন্য দুর্নীতি অর্থনীতিকে গ্রাস করতে চলেছে। অনুরোধ থাকবে রেন্টাল-কুইক রেন্টালের এই সর্বনাশা পদ্ধতি থেকে ফিরে আসুন। যে বোঝা ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে অর্থনীতির ওপর চাপানো হয়েছে, সে বোঝা অর্থনীতির বহনের কোনো ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা আছে তার মূল্য দিতে হবে দরিদ্র এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোক্তাদের।
শেষ কথা হলো, অর্থনীতিতে যেসব আপদ আজকে জেঁকে বসেছে তার বেশির ভাগই সরকারের ভুল পলিসিরই ফল। অর্থনীতিতে একটা অনাস্থা ও হতাশার ভাব বিরাজ করছে। ভোক্তা দুঃখে আছে, বিনিয়োগকারী দুঃখে আছে, শেয়ারবাজারের লোকজন দুঃখে আছে, সৎ লোকজন দুঃখে আছে। তাহলে এই অর্থনীতিতে কে সুখে আছে?

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

আমাদের প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর মোজাফফর আহমদ



॥ আবু আহমেদ ॥

স্যারের সরাসরি ছাত্র হইনি আমি কখনো। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে এলেন, তখন আমি অর্থনীতি বিভাগের বাইরে, আর আমি যখন শিক্ষক হিসেবে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দিই তখন তিনি অর্থ বিভাগ ছেড়ে ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে বা আইবিএতে চলে গিয়েছিলেন। আমার জানা মতে, তখন আইবিএ শিক্ষকস্বল্পতায় ভুগছিল। তার যোগদানের মাধ্যমে আইবিএতে সেই শূন্যতা কিছুটা পূরণ হয়। বলা চলে, সত্তর দশকের শুরুতে বা আমাদের স্বাধীনতার অব্যবহিত পর ঢাবি অর্থনীতি বিভাগের জন্য স্বর্ণযুগ ছিল। তখন প্রথিতযশা অনেক অর্থনীতিবিদই এই বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সোবহান, প্রফেসর আনিসুর রহমান, প্রফেসর এমএন হুদা, প্রফেসর মোশাররফ হোসেন প্রমুখ। প্রফেসর মোজাফফর যখন আইবিএতে যোগদান করেন, তার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে ইনস্টিটিউটেরও সোনালি দিন শুরু হয়। তার মতো আদর্শবাদী এবং জ্ঞানে সমৃদ্ধ শিক্ষক ছিলেন বলেই আইবিএ অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়। ছাত্র ভর্তি হয় শিক্ষকদের দেখে। অন্তত আইবিএর গ্র্যাজুয়েটদের যে এত সম্মান ও মূল্য ছিল, তার কারণ তারা প্রফেসর মোজাফফর আহমদের মতো শিক্ষাবিদের ছাত্র ছিলেন। আজো লোকে এর গ্র্যাজুয়টদের বেশি কদর করে। এর মূল কারণ হলো, এই ইনস্টিটিউটগুলো তাদের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্তত বাইরের ধারণা এটাই। প্রফেসর মোজাফফর আহমদের বর্ণাঢ্য জীবন ছিল। আসলে প্রতিভাবান লোকেরা এক জায়গায় বসে থাকেন না। তাদের চাহিদা যেমন ব্যাপক, যাকে তেমন এসব লোক নিজের কর্মদক্ষতাকে অন্যত্রও ব্যবহার করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলাদেশের প্ল্যানিং কমিশনেও কাজ করেছেন এবং এর আগে সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি শিল্প গড়ার প্রতিষ্ঠান ইপিআইডিসি-তে উঁচু পদে কাজ করেছেন। বলা যেতে পারে, স্বাধীনতাপূর্ব যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেগুলোর পেছনে প্রফেসর মোজাফফরেরও বড় অবদান ছিল। এগুলোর মধ্যে ছিল চট্টগ্রামের স্টিল মিলস, কর্ণফুলী পেপার মিলস ইত্যাদি। একপর্যায়ে তিনি মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময় বস্ত্রশিল্প উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন। বলা চলে, মোজাফফর আহমদের মতো লোকদের হাতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো যত দিন ছিল তত দিন ওগুলো ভালোই চলেছিল। এসব শিল্পকারখানা ক্ষয় হতে থাকে পরের দশকে যা আজো অব্যাহত আছে। মোজাফফর স্যার আমেরিকার বিখ্যাত শিকাগো ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন। সেই শিকাগো ‘স্কুল’ কিন্তু পুরোপুরি বাজারমুখী একটা স্কুল। অর্থাৎ ধরে নেয়া হয় সেখান থেকে পাস করা ছাত্রদের শিক্ষাগতভাবেই তারা বাজার অর্থনীতির প্রতি দুর্বল থাকবে এবং পাবলিক সেক্টর অর্থাৎ সরকার নিয়ন্ত্রিত ও সরকারের মালিকানাধীন ব্যবসায়-বাণিজ্যের বিরোধিতা করবেন। কিন্তু স্যারের মধ্যে ওই আদর্শিক প্রবণতা দেখিনি। তিনি পাবলিক সেক্টর এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে তো ছিলেন না, বরং ওগুলো সঠিকভাবে চালাতে নানাবিধ কৌশলের কথা বলতেন। অনেক সভা-সেমিনারে আমি স্যারের সাথে বিনয়ের মাধ্যমে দ্বিমত পোষণ করতাম পাবলিক সেক্টরের ভূমিকা নিয়ে। অন্যভাবে যেটা পর্যবেক্ষণ করেছি, সেটা হলো ষাট ও সত্তর দশকের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে পাবলিক সেক্টরের প্রতি একধরনের ভক্তি ছিল। হয়তো এমন হবে যে, বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পলিটিক্যাল ইকোনমির দারুণ প্রভাব। তখনো বিশ্বে সমাজতন্ত্র না পুঁজিবাদ বা বাজার অর্থনীতি, এমন একটা বিতর্ক প্রবলভাবে চলছিল। আমাদের দেশের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিদেরাও ওই বিতর্কে প্রভাবিত হয়েছিলেন। একধরনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থার প্রতি তাদের বেশ দুর্বলতা ছিল। তাদের যুক্তি এবং অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করেছি এবং বলা চলে, দ্বিমত থাকলেও তাদের যুক্তি বুঝতে সক্ষম হয়েছি। তাদের মধ্যে অনেকে দারিদ্র্যকে হঠানোর জন্য রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত অর্থনীতির পক্ষে ছিলেন। প্রফেসর মোজাফফর আহমদ উন্মুক্ত বাজারের বিপক্ষে ছিলেন। তার যুক্তি ছিল, এমন বাজার শোষকদের হাতে অপব্যবহৃত হয় এবং অনিয়ন্ত্রিত বাজার একচেটিয়া মুনাফার জন্ম দেয়। হ্যাঁ, স্যারের এই তত্ত্ব ভাবনায় আমিও অংশীদার। সে জন্য বাজার অর্থনীতির পক্ষে বলতে গিয়ে সব সময় বলি, বাজার দরকার, তবে বাজার অবশ্যই সুনিয়ন্ত্রিত হতে হবে। দুর্ভাগ্য, আজকে আমাদের এই বাজার অর্থনীতিতে রেগুলেশন বলতে তেমন কিছু নেই। তাই তো দেশে হাজার হাজার কোটি কালো টাকার উৎপাদন হচ্ছে। তাই তো দেশের বিপুল অর্থ বিদেশ পাড়ি দিচ্ছে। মোজাফফর স্যারের সাথে আইবিএর কক্ষে প্রায় দেখা হতো। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন। আমি অনেক কথা শুনতাম এবং তার থেকে অনেক কিছু জেনেছিও। বুঝতাম যে, স্যার কথা ও বিশ্বাসে এক। যেটা বিশ্বাস করতেন সেটাই বলতেন। অবসর নেয়ার পরও স্যার কাজ থেকে দূরে থাকেননি। তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন দেশ থেকে দুর্নীতি কিভাবে তাড়ানো যায়। গঠন করলেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইবি বাংলাদেশ চ্যাপ্টার। এই টিআইবির মাধ্যমে মানুষ জানল, বাংলাদেশে দুর্নীতি কত গভীরে। মোজাফফর স্যার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোর দিয়ে বলতেন বলে সমাজের কথিত ক্ষমতাধরেরা তাকে প্রতিপক্ষ মনে করতেন। কিন্তু তিনি যা করেছিলেন সেটা এই দেশের মানুষের জন্যই করেছিলেন। আজকে তিনি নেই। আমরা উপলব্ধি করছি বাংলাদেশ দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা জোরালো কণ্ঠস্বর হারাল। আমি তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। 
লেখন : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রবিবার, ২০ মে, ২০১২

রাজনৈতিক সংঘাত সমাধান করুন অর্থনীতি ভালো হবে

বাংলাদেশের অর্থনীতিটা গত দেড় বছর থেকে কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, ফরেন এঙ্চেঞ্জ রিজার্ভ কমছে, রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হারও পেছনে, টাকা-ডলার বিনিময় হারে টাকা ডলারের কাছে মার খাচ্ছে। সরকার পুরো বছরের প্রাক্কলিত অভ্যন্তরীণ ঋণ পাঁচ মাসে নিয়ে ফেলেছে, বিদেশি উৎস থেকে সাহায্য ও অনুদান একরকম বন্ধ, বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করতে হয়েছে, বড় কোনো প্রকল্প সরকার হাতে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। পদ্মা ব্রিজের অর্থায়নের উৎস নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্রিজ কোনো সস্তা পুঁজিতে অর্থায়ন হবে বলে মনে হয় না। বিদেশি ব্যক্তিপুঁজির মাধ্যমে অর্থায়ন করা হলে এই ব্রিজের ভার জাতির জন্য অনেক বেশি হবে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির দরজা কেন বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হবে, তা ভেবে দেখা দরকার। এই সরকারের আমলে বড় বৈদেশিক ঋণটি নেওয়া হয়েছে ভারত থেকে। কিন্তু জনগণ যতই প্রশ্ন করে, এই ঋণের ব্যবহার কী? এই ঋণের মাধ্যমে যদি ভারতের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয় এবং ভারত থেকে পণ্য ও নির্মাণসামগ্রী আনা হয়, তাহলে বাংলাদেশের কী লাভ হলো? ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ট্রানজিটের একটা অর্থনীতি আছে। বাংলাদেশ কি এ ক্ষেত্রে তার পক্ষে যেতে পারে এমন অর্থনীতিগুলো বিবেচনায় আনছে? ভারত তো সব কিছুই বিনা মূল্যে চাইবে, কিন্তু বাংলাদেশ রাজি হবে কেন? মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের মূল্য অনেক বেশি। বাংলাদেশ যদি হিসাব কষতে জানে, তাহলে এসব বন্দর তৃতীয়পক্ষকে ব্যবহার করতে দিয়ে বিলিয়নস অব ডলার পেতে পারে। কিন্তু সে জন্য হিসাবটা কষতে জানতে হবে। এখন ভারত বলছে, দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও সমুদ্রসীমা সমস্যার সমাধান করা যায়। বাংলাদেশ একসময় দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নিরূপণের জন্য অনেক আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ভারত তখন বাংলাদেশকে পাত্তাই দেয়নি। তিস্তার পানির ক্ষেত্রে ভারত ষোল আনা দাবি করছে। জলডোবায় যদি পানিই না থাকে, তাহলে কোন পানি বণ্টন করা হবে? আজকে ভারত বলছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, এত পানি বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে না, তাই কাঙ্ক্ষিত তিস্তা চুক্তি হতে গিয়েও হয়নি। তাহলে মমতাই কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারেন? একই ইস্যু যদি পাকিস্তানের সঙ্গে হতো, তাহলে ভারতের গুজরাট অথবা পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীরা কি ভেটো দিতে পারতেন? এখানে মমতা যা বোঝেন এবং দিলি্লর সরকারও যা বোঝে তা হলো, প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ অতি দুর্বল। আর বাংলাদেশের সরকার ভারতের বন্ধুত্বের জন্য এতই আগ্রহী যে ওই তিস্তার পানি না পেলেও সেই বন্ধুত্ব শুধু সমৃদ্ধই হতে থাকবে!
যা হোক, অর্থনীতির ক্ষেত্রে আসি। অর্থনীতির মূল সূচকগুলো ভালো যাচ্ছে না। এর মূল কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে ভুল পলিসির অনুসরণ। মূল্যস্ফীতি রোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনশীল মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার মাত্র দেড় বছরে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। ফল হয়েছে বিনিয়োগ হ্রাস এবং আশাবাদের একটা বড় পিছুটান। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পলিসি অর্থনীতির জন্য শুধু খারাপই নয়, বরং মূল্যস্ফীতিকেই এই নীতি সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত এ পলিসি থেকে ফেরতও আসবে না এবং অর্থনীতিতে সামনে কোনো সুদিন আছে- এমনো কেউ আশা করে না। সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমিয়ে যেটা অর্জন করতে চাওয়া হচ্ছে, সেটার নেট ফলাফল অর্থনীতির জন্য অবশ্যই ঋণাত্মক।
বাজার অর্থনীতি চলে এক স্বচ্ছ আশাবাদ দ্বারা। আমাদের অর্থনীতিতে আশাবাদের ক্ষেত্রগুলো সবই যেন নিভে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারকে ঘিরে অর্থনীতিতে একটা সহনীয় আশাবাদ জাগরিত থাকতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি এই বাজারকে এমনভাবে আঘাত করেছে যে এখন এ বাজার অনেক কথিত প্রণোদনা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। তবুও আমরা বলতে থাকব, এই বাজারকে ঘিরে সংস্কার কাজগুলো চালু থাকুক। ওই সবের ফল একদিন অর্থনীতি অবশ্যই পাবে। এখন লোকজন সঞ্চয় করতে সক্ষম হচ্ছে না। বরং অনেকে পেছনের সঞ্চয়গুলো ভেঙে ভেঙে ভোগ করছে। বলা চলে, অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও ভোগ- উভয় পেছনে যাচ্ছে। তাই অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বিনিয়োগ হবে না এবং কর্মসংস্থানও হবে না।
অর্থনীতিকে অন্য যে বিষয়টি আঘাত করে চলেছে সেটা হলো, রাজনৈতিক সংঘাত। সামনের সাধারণ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় কি না সে নিয়ে অধিকাংশ লোক শঙ্কায় আছে। দেশের জনগণ যদি দেখে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে যাচ্ছে, তাহলে অর্থনীতি আপনা থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। তখন শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করার জন্য এত প্রণোদনারও দরকার হবে না। লোকে মনে করতে থাকবে শেয়ারবাজার বাড়বে বা বেড়ে যাবে।
রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনের বড় দায়িত্ব সরকারেরই। কারণ সরকারই কেবল নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য পরিবেশ দিতে পারে। একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না যে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ হতে যাচ্ছে না। বিড়ালটি কালো কি সাদা, সে নিয়ে বিতর্ক করে সময়ক্ষেপণ না করে দেখা উচিত, বিড়ালটা ইঁদুর মারে কি না। তাই নির্বাচনের সময়ে সরকার কি নামে অভিহিত হবে, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, ওই সরকার নিরপেক্ষ হবে কি না।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বুধবার, ১৬ মে, ২০১২

আইএমএফের ঋণ শর্তসাপেক্ষেই হয়

আইএমএফের ঋণ শর্তসাপেক্ষেই হয়



॥ আবু আহমেদ ॥

কোথাও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ শর্ত ছাড়া ঋণ দিয়েছে কি না আমার জনা নেই। আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)Ñ এদের কাজই হলো ঋণ বিক্রয় করা, অবশ্য ওদের মতে, কনসেশন দেয়া শর্তে। কনসেশন বা ছাড় দুটো ক্ষেত্রে এরা দেয়। সেই দুটো ক্ষেত্র হলোÑ সুদের নিম্ন হার এবং ঋণ ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বছর সময় দেয়া। এদের ঋণের ‘ভালো’ গ্রাহক হলোÑ দরিদ্র দেশগুলো, উঠতি বা ইমারজিং অর্থনীতির দেশগুলো। এদের থেকে ঋণ নিলেও অনেকটা বাছবিচার করেই নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ছোট ও দরিদ্র অর্থনীতির দেশের পক্ষে বাছবিচার করার ক্ষেত্রে ততটা অপশান বা বিকল্প থাকে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্যক্তি খাতে কোনো ঋণ দেয় না। এরা ঋণ সহায়তা দেয়, তথা ঋণ বিক্রয় করে ঋণের ক্রেতা দেশগুলোর সরকারের কাছে। সে হিসাবে এদের ঋণ ১০০ শতাংশ নিরাপদ। কেন না, আজ হোক কাল হোক এই ঋণ সদস্যদেশগুলো সুদে আসলে ফেরত দেয়। তবে সত্য হলো, এসব দেশ সহজে ঋণের দুষ্ট চক্র থেকে বের হতে পারে না। বরং এক ঋণ ফেরত দেয়ার জন্য আর এক ঋণ গ্রহণ করতে হয়; যেমন আমাদের বাংলাদেশ। এই দেশ স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪১ বছরে অনেক বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে এবং শোধও করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এখন আমার জানামতে বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ জমা আছে। এই ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ৯০০ মিলিয়ন ডলার সুদ আসলে ফেরত দিতে হচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? সেটা হলোÑ বাংলাদেশ সরকার যদি বিভিন্ন সূত্র থেকে বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ পায়, তার থেকে অর্ধেকেরও বেশি পুনর্বার ডলারে বিদেশী কথিত এসব সাহায্যসংস্থাকে ফেরত দিতে হচ্ছে। বর্তমানে ব্যয় করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের হাতে বৈদেশিক সাহায্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থের তেমন বড় অংশ থাকে না। প্রশ্ন হতে পারে, এসব সূত্র থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য না পেলে বাংলাদেশ সরকার কি আগে ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে পারত না? পারত, তবে কষ্ট হতো এবং অন্য উৎস থেকে দিতে হতো। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে স্থানীয় মুদ্রা, টাকায় ঋণ নিয়ে এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা স্থানীয় আর্থিক বাজার থেকে ডলার ক্রয় করে কথিত দাতাদের সে ঋণ পরিশোধ করতে হতো। বিশ্বব্যাংক যে প্রাইভেট সেক্টর তথা ব্যক্তি খাতে ঋণ দেয় না তা নয়। বিশ্বব্যাংকের একটা শাখা বা উইং আছে যেটা আইএফসি নামে পরিচিত। সেই আইএফসি ব্যক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ দিয়ে থাকে। আইএফসি কখনো কমন ইকুইটি তথা শেয়ার ক্রয় করার মাধ্যমেও অর্থের জোগান দেয়। তবে এর ঋণ পুরো বাণিজ্যিক এবং বাংলাদেশে আইএফসি ভালোই ব্যবসায় করেছে। আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়া মানে, দাতারা ঋণগ্রহিতা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্ট। আইএফসি সনদ না দিলে বাংলাদেশের মতো দেশকে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কোনো ঋণ দেবে না। এসব সংস্থা ঋণ দেয়ার আগে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়। শর্তগুলোর মধ্যে থাকে ম্যাক্রো ইকোনোমিক ম্যানেজমেন্ট সম্বন্ধেই বেশি। ঋণ ক্রেতা দেশের কেমন মুদ্রানীতি হবে, ওই দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বিনিময় হার কেমন হবে, সরকার কতটা ঋণ করতে পারবে, কতটা ভর্তুকি দিতে পারবে এসব নিয়ে আইএমএফ অনেক শর্ত দেয়। এই সংস্থা প্রতিশ্রুত ঋণকে একসাথে কোনো সরকারের আমলে দিয়ে দেয় না। এরা ঋণ ছাড় করে কিস্তিতে। কিস্তিতে ঋণ ছাড় করতে গিয়ে প্রতিশ্রুত শর্তগুলো সরকার পূরণ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখে। না করলে কিস্তি ছাড় করতে দেরি করে, এমনকি বাতিলও করে দেয়। মোট কথা, ছোট অর্থনীতিগুলো বিশ্বের পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে আইএমএফের ভালো নজরে থাকতে হয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিকে ভোট প্রদান করার ক্ষমতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও কিছু ইউরোপীয় দেশ। অন্য সদস্যদেশগুলোর ভোট কম। তাই তারা শুধু বলে। শোনার ব্যাপারটা অনেকটাই নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের এবং তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের ওপর। বাংলাদেশ যে এক বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ ঋণ পেল, তাতে খুশি হওয়ার তেমন কিছু নেই। প্রথমত, এই ঋণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দ্বিতীয়ত, এই ঋণ পেতে হলে সরকারকে অনেক শর্ত মানতে হবে। বলা চলে, আর্থিক এবং রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক আপস করতে হবে। আইএমএফ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি তুলে দেয়ার শর্ত দিলো। এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যে ভোক্তাদের দ্বিগুণ মূল্যে বিদ্যুৎ-গ্যাস কিনতে হবে। 
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

রবিবার, ৬ মে, ২০১২

প্রবৃদ্ধিতে এত খরা কেন!

প্রবৃদ্ধিতে এত খরা কেন!



॥ আবু আহমেদ ॥

আমরা অনেকটা আশাবাদী ছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের অর্থনীতি শুধু উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে প্রবেশ করবে। কিন্তু আমাদের সেই আশায় ছেদ পড়েছে। এখন বাস্তব অবস্থা হলো, আমাদের জাতীয় অর্থনীতি গত এক দশকের গড় প্রবৃদ্ধিকেও ধরে রাখতে পারবে না। অর্থমন্ত্রী যখন গত বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, জিডিপি তথা জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ শতাংশ, তখন এক দিকে আমরা খুশি হলেও অন্য দিকে শঙ্কার মধ্যে ছিলাম। তা এ কারণে যে, অর্থনীতিতে যে হাওয়া বইছে তাতে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না এবং ৬.৫ শতাংশ অর্জন করতে পারলেই আমরা খুশি হবো। আমাদের সেই আশঙ্কাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে আরো নিচে প্রাক্কলন করছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ কিংবা তার থেকে একটু বেশি বা কম হতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০১১-২০১২ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ শতাংশ হবে বলে দিয়েছে। ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে, আমার জানা মতে, এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে প্রবৃদ্ধি যে ৭ শতাংশ, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে ৬.৫ শতাংশও হবে না, সে ব্যাপারে আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। প্রবৃদ্ধি আসে বিনিয়োগ থেকে। প্রবৃদ্ধির অন্য উৎস হলো প্রডাকটিভিটি বা উৎপাদনশীলতা। পরের উপাদানটিকে স্থির ধরলে প্রবৃদ্ধির জন্য একক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা উৎস হলো অর্থনীতিতে বিনিয়োগের পরিমাণ। এই বিনিয়োগ দেশের ভেতর থেকে হতে পারে, আবার বাইরের থেকেও হতে পারে। আমাদের অর্থনীতিতে প্রডাকটিভিটির যে অবস্থান তা বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে, ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগের প্রয়োজন জিডিপির কমপক্ষে ২৮-৩০ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি কি ওই পরিমাণ বিনিয়োগ পেয়েছে? বরং বিনিয়োগ সূচক সেই জুন, ২০১০-এর পর থেকেই নিম্নমুখী। বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি। এই নীতি আর্থিক বাজারে তারল্যসঙ্কট সৃষ্টি করেছে এবং এর ফলে এখন অর্থনীতিতে সুদের হার গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। যে সুদের হার ছিল ৯-১০ শতাংশ সেই হার এখন দ্বিগুণ। লক্ষণীয় যে, ২০১০ সালের জুন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের নির্দেশে সঙ্কোচনশীল মুদ্রানীতি অনুসরণ করা শুরু করেছে মূল্যস্ফীতি রোধের দোহাই দিয়ে। এখন অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে কি না, সেটা ভোক্তারাই ভালো জানেন। আমরা শুধু বলে আসছিলাম, ওই বিনিয়োগবিরোধী মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতিকে শুধু বাড়াতেই থাকবে। আজ আমাদের শঙ্কা শতভাগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন আইএমএফ বলছে, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৫ শতাংশ হবে। এর দায়ভার আইএমএফকেও নিতে হবে। তবে সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় ব্যর্থতা হলো বাংলাদেশ সরকারের। কেউ কি কোনো দিন শুনেছে বিনিয়োগ কমে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেলে তখন অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান বাড়ে, মূল্যস্ফীতি কমে! এখন যেটা হচ্ছে এবং হবে সেটা হলো, ভুল অর্থনীতি গ্রহণের ফলে অর্থনীতি এক ধরনের মন্দা অবস্থায় অবস্থান করবে। এর অর্থ হলোÑ কম বিনিয়োগ, কম ব্যয় এবং কম ভোগ। সর্বত্রই অর্থনীতিকে ‘কমের’ মধ্যে থাকতে হবে। আইএমএফ তাদের নিজেদের কথা বলবেই। ওগুলো বলা তাদের কাজের শর্তের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ছোট ও দুর্বল অর্থনীতিও আইএমএফকে ‘না’ করে দেয়। দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশের নেতৃত্ব এতই দুর্বল যে, শুধু এক বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য তাদের ‘কমের’ সবক পেয়েও ‘না’ বলতে পারেনি। কিন্তু সেই এক বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় কতটুকু? একটা হিসাব হলো এই রকম, বাংলাদেশ রফতানি ও রেমিট্যান্স বাবদ প্রতি বছর ৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে। তাহলে এক বিলিয়ন মানে এর ভাগ মাত্র। আর শুধু এই জন্য বাংলাদেশকে এত শর্ত মানতে হচ্ছে। মেরুদণ্ড খাড়া করে আমাদের নেতৃত্ব কি বলতে পারত না, আইএমএফ, আমাদের এক বিলিয়ন ডলার চাই বটে; তবে সঙ্কোচনশীল মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে পারব না এবং অহরহ ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়াতেও পারব না। আইএমএফ যদি বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে সাহায্য করতে চাইত, তাহলে বাংলাদেশ সরকার যে প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছে, এতে বাধা দিত। আজ সবাই জানে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেই ভর্তুকির দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর। সেই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্রজেক্টের মালিক কারা? দেশী-বিদেশী ওই ব্যক্তি-উদ্যোক্তারা। ব্যক্তি-উদ্যোক্তারা একচেটিয়া মুনাফার ফাঁদ বসালেও সরকারের যেমন আপত্তি নেই, তেমনি নেই আইএমএফেরও। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষের স্বার্থ এক হলো কী করে? আমরা জানি, ‘আইএমএফ বলবে, কী উৎস থেকে তোমাদের সরকার বিদ্যুৎ কিনবে সে ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। আমরা শুধু ধরব ভর্তুকি দেয়ার নীতিকে এবং তোমাদের ম্যাক্রো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে।’ কিন্তু এ রকম ভূমিকার শিকার হচ্ছে এ দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণীর ভোক্তারা। অর্থনীতির আসল দায়টা বহন করছে এই দুই শ্রেণীর লোকেরাই। 
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়