বাংলাদেশের অর্থনীতিটা গত দেড় বছর থেকে কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, ফরেন এঙ্চেঞ্জ রিজার্ভ কমছে, রপ্তানির প্রবৃদ্ধির হারও পেছনে, টাকা-ডলার বিনিময় হারে টাকা ডলারের কাছে মার খাচ্ছে। সরকার পুরো বছরের প্রাক্কলিত অভ্যন্তরীণ ঋণ পাঁচ মাসে নিয়ে ফেলেছে, বিদেশি উৎস থেকে সাহায্য ও অনুদান একরকম বন্ধ, বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় কাটছাঁট করতে হয়েছে, বড় কোনো প্রকল্প সরকার হাতে নিতে পারবে বলে মনে হয় না। পদ্মা ব্রিজের অর্থায়নের উৎস নিয়ে অনেক কিছু বলা হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ব্রিজ কোনো সস্তা পুঁজিতে অর্থায়ন হবে বলে মনে হয় না। বিদেশি ব্যক্তিপুঁজির মাধ্যমে অর্থায়ন করা হলে এই ব্রিজের ভার জাতির জন্য অনেক বেশি হবে। বিশ্বব্যাংক ও এডিবির দরজা কেন বাংলাদেশের জন্য বন্ধ হবে, তা ভেবে দেখা দরকার। এই সরকারের আমলে বড় বৈদেশিক ঋণটি নেওয়া হয়েছে ভারত থেকে। কিন্তু জনগণ যতই প্রশ্ন করে, এই ঋণের ব্যবহার কী? এই ঋণের মাধ্যমে যদি ভারতের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয় এবং ভারত থেকে পণ্য ও নির্মাণসামগ্রী আনা হয়, তাহলে বাংলাদেশের কী লাভ হলো? ভারতকে ট্রানজিট দেওয়া-না দেওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ট্রানজিটের একটা অর্থনীতি আছে। বাংলাদেশ কি এ ক্ষেত্রে তার পক্ষে যেতে পারে এমন অর্থনীতিগুলো বিবেচনায় আনছে? ভারত তো সব কিছুই বিনা মূল্যে চাইবে, কিন্তু বাংলাদেশ রাজি হবে কেন? মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের মূল্য অনেক বেশি। বাংলাদেশ যদি হিসাব কষতে জানে, তাহলে এসব বন্দর তৃতীয়পক্ষকে ব্যবহার করতে দিয়ে বিলিয়নস অব ডলার পেতে পারে। কিন্তু সে জন্য হিসাবটা কষতে জানতে হবে। এখন ভারত বলছে, দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতেও সমুদ্রসীমা সমস্যার সমাধান করা যায়। বাংলাদেশ একসময় দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমুদ্রসীমা নিরূপণের জন্য অনেক আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো, ভারত তখন বাংলাদেশকে পাত্তাই দেয়নি। তিস্তার পানির ক্ষেত্রে ভারত ষোল আনা দাবি করছে। জলডোবায় যদি পানিই না থাকে, তাহলে কোন পানি বণ্টন করা হবে? আজকে ভারত বলছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, এত পানি বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে না, তাই কাঙ্ক্ষিত তিস্তা চুক্তি হতে গিয়েও হয়নি। তাহলে মমতাই কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারেন? একই ইস্যু যদি পাকিস্তানের সঙ্গে হতো, তাহলে ভারতের গুজরাট অথবা পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীরা কি ভেটো দিতে পারতেন? এখানে মমতা যা বোঝেন এবং দিলি্লর সরকারও যা বোঝে তা হলো, প্রতিপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ অতি দুর্বল। আর বাংলাদেশের সরকার ভারতের বন্ধুত্বের জন্য এতই আগ্রহী যে ওই তিস্তার পানি না পেলেও সেই বন্ধুত্ব শুধু সমৃদ্ধই হতে থাকবে!
যা হোক, অর্থনীতির ক্ষেত্রে আসি। অর্থনীতির মূল সূচকগুলো ভালো যাচ্ছে না। এর মূল কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে ভুল পলিসির অনুসরণ। মূল্যস্ফীতি রোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনশীল মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার মাত্র দেড় বছরে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। ফল হয়েছে বিনিয়োগ হ্রাস এবং আশাবাদের একটা বড় পিছুটান। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পলিসি অর্থনীতির জন্য শুধু খারাপই নয়, বরং মূল্যস্ফীতিকেই এই নীতি সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত এ পলিসি থেকে ফেরতও আসবে না এবং অর্থনীতিতে সামনে কোনো সুদিন আছে- এমনো কেউ আশা করে না। সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমিয়ে যেটা অর্জন করতে চাওয়া হচ্ছে, সেটার নেট ফলাফল অর্থনীতির জন্য অবশ্যই ঋণাত্মক।
বাজার অর্থনীতি চলে এক স্বচ্ছ আশাবাদ দ্বারা। আমাদের অর্থনীতিতে আশাবাদের ক্ষেত্রগুলো সবই যেন নিভে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারকে ঘিরে অর্থনীতিতে একটা সহনীয় আশাবাদ জাগরিত থাকতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি এই বাজারকে এমনভাবে আঘাত করেছে যে এখন এ বাজার অনেক কথিত প্রণোদনা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। তবুও আমরা বলতে থাকব, এই বাজারকে ঘিরে সংস্কার কাজগুলো চালু থাকুক। ওই সবের ফল একদিন অর্থনীতি অবশ্যই পাবে। এখন লোকজন সঞ্চয় করতে সক্ষম হচ্ছে না। বরং অনেকে পেছনের সঞ্চয়গুলো ভেঙে ভেঙে ভোগ করছে। বলা চলে, অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও ভোগ- উভয় পেছনে যাচ্ছে। তাই অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বিনিয়োগ হবে না এবং কর্মসংস্থানও হবে না।
অর্থনীতিকে অন্য যে বিষয়টি আঘাত করে চলেছে সেটা হলো, রাজনৈতিক সংঘাত। সামনের সাধারণ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় কি না সে নিয়ে অধিকাংশ লোক শঙ্কায় আছে। দেশের জনগণ যদি দেখে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে যাচ্ছে, তাহলে অর্থনীতি আপনা থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। তখন শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করার জন্য এত প্রণোদনারও দরকার হবে না। লোকে মনে করতে থাকবে শেয়ারবাজার বাড়বে বা বেড়ে যাবে।
রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনের বড় দায়িত্ব সরকারেরই। কারণ সরকারই কেবল নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য পরিবেশ দিতে পারে। একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না যে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ হতে যাচ্ছে না। বিড়ালটি কালো কি সাদা, সে নিয়ে বিতর্ক করে সময়ক্ষেপণ না করে দেখা উচিত, বিড়ালটা ইঁদুর মারে কি না। তাই নির্বাচনের সময়ে সরকার কি নামে অভিহিত হবে, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, ওই সরকার নিরপেক্ষ হবে কি না।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
যা হোক, অর্থনীতির ক্ষেত্রে আসি। অর্থনীতির মূল সূচকগুলো ভালো যাচ্ছে না। এর মূল কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে ভুল পলিসির অনুসরণ। মূল্যস্ফীতি রোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনশীল মুদ্রানীতির মাধ্যমে সুদের হার মাত্র দেড় বছরে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করেছে। ফল হয়েছে বিনিয়োগ হ্রাস এবং আশাবাদের একটা বড় পিছুটান। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই পলিসি অর্থনীতির জন্য শুধু খারাপই নয়, বরং মূল্যস্ফীতিকেই এই নীতি সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আপাতত এ পলিসি থেকে ফেরতও আসবে না এবং অর্থনীতিতে সামনে কোনো সুদিন আছে- এমনো কেউ আশা করে না। সুদের হার বাড়িয়ে চাহিদা কমিয়ে যেটা অর্জন করতে চাওয়া হচ্ছে, সেটার নেট ফলাফল অর্থনীতির জন্য অবশ্যই ঋণাত্মক।
বাজার অর্থনীতি চলে এক স্বচ্ছ আশাবাদ দ্বারা। আমাদের অর্থনীতিতে আশাবাদের ক্ষেত্রগুলো সবই যেন নিভে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারকে ঘিরে অর্থনীতিতে একটা সহনীয় আশাবাদ জাগরিত থাকতে পারত। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি এই বাজারকে এমনভাবে আঘাত করেছে যে এখন এ বাজার অনেক কথিত প্রণোদনা সত্ত্বেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। তবুও আমরা বলতে থাকব, এই বাজারকে ঘিরে সংস্কার কাজগুলো চালু থাকুক। ওই সবের ফল একদিন অর্থনীতি অবশ্যই পাবে। এখন লোকজন সঞ্চয় করতে সক্ষম হচ্ছে না। বরং অনেকে পেছনের সঞ্চয়গুলো ভেঙে ভেঙে ভোগ করছে। বলা চলে, অর্থনীতিতে সঞ্চয় ও ভোগ- উভয় পেছনে যাচ্ছে। তাই অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বিনিয়োগ হবে না এবং কর্মসংস্থানও হবে না।
অর্থনীতিকে অন্য যে বিষয়টি আঘাত করে চলেছে সেটা হলো, রাজনৈতিক সংঘাত। সামনের সাধারণ নির্বাচন নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয় কি না সে নিয়ে অধিকাংশ লোক শঙ্কায় আছে। দেশের জনগণ যদি দেখে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হতে যাচ্ছে, তাহলে অর্থনীতি আপনা থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। তখন শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করার জন্য এত প্রণোদনারও দরকার হবে না। লোকে মনে করতে থাকবে শেয়ারবাজার বাড়বে বা বেড়ে যাবে।
রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনের বড় দায়িত্ব সরকারেরই। কারণ সরকারই কেবল নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য পরিবেশ দিতে পারে। একটা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে কারো মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না যে নির্বাচনটা নিরপেক্ষ হতে যাচ্ছে না। বিড়ালটি কালো কি সাদা, সে নিয়ে বিতর্ক করে সময়ক্ষেপণ না করে দেখা উচিত, বিড়ালটা ইঁদুর মারে কি না। তাই নির্বাচনের সময়ে সরকার কি নামে অভিহিত হবে, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, ওই সরকার নিরপেক্ষ হবে কি না।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন