॥ আবু আহমেদ ॥
কোথাও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ শর্ত ছাড়া ঋণ দিয়েছে কি না আমার জনা নেই। আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)Ñ এদের কাজই হলো ঋণ বিক্রয় করা, অবশ্য ওদের মতে, কনসেশন দেয়া শর্তে। কনসেশন বা ছাড় দুটো ক্ষেত্রে এরা দেয়। সেই দুটো ক্ষেত্র হলোÑ সুদের নিম্ন হার এবং ঋণ ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বছর সময় দেয়া। এদের ঋণের ‘ভালো’ গ্রাহক হলোÑ দরিদ্র দেশগুলো, উঠতি বা ইমারজিং অর্থনীতির দেশগুলো। এদের থেকে ঋণ নিলেও অনেকটা বাছবিচার করেই নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ছোট ও দরিদ্র অর্থনীতির দেশের পক্ষে বাছবিচার করার ক্ষেত্রে ততটা অপশান বা বিকল্প থাকে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্যক্তি খাতে কোনো ঋণ দেয় না। এরা ঋণ সহায়তা দেয়, তথা ঋণ বিক্রয় করে ঋণের ক্রেতা দেশগুলোর সরকারের কাছে। সে হিসাবে এদের ঋণ ১০০ শতাংশ নিরাপদ। কেন না, আজ হোক কাল হোক এই ঋণ সদস্যদেশগুলো সুদে আসলে ফেরত দেয়। তবে সত্য হলো, এসব দেশ সহজে ঋণের দুষ্ট চক্র থেকে বের হতে পারে না। বরং এক ঋণ ফেরত দেয়ার জন্য আর এক ঋণ গ্রহণ করতে হয়; যেমন আমাদের বাংলাদেশ। এই দেশ স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪১ বছরে অনেক বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে এবং শোধও করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এখন আমার জানামতে বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ জমা আছে। এই ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ৯০০ মিলিয়ন ডলার সুদ আসলে ফেরত দিতে হচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? সেটা হলোÑ বাংলাদেশ সরকার যদি বিভিন্ন সূত্র থেকে বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ পায়, তার থেকে অর্ধেকেরও বেশি পুনর্বার ডলারে বিদেশী কথিত এসব সাহায্যসংস্থাকে ফেরত দিতে হচ্ছে। বর্তমানে ব্যয় করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের হাতে বৈদেশিক সাহায্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থের তেমন বড় অংশ থাকে না। প্রশ্ন হতে পারে, এসব সূত্র থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য না পেলে বাংলাদেশ সরকার কি আগে ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে পারত না? পারত, তবে কষ্ট হতো এবং অন্য উৎস থেকে দিতে হতো। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে স্থানীয় মুদ্রা, টাকায় ঋণ নিয়ে এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা স্থানীয় আর্থিক বাজার থেকে ডলার ক্রয় করে কথিত দাতাদের সে ঋণ পরিশোধ করতে হতো। বিশ্বব্যাংক যে প্রাইভেট সেক্টর তথা ব্যক্তি খাতে ঋণ দেয় না তা নয়। বিশ্বব্যাংকের একটা শাখা বা উইং আছে যেটা আইএফসি নামে পরিচিত। সেই আইএফসি ব্যক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ দিয়ে থাকে। আইএফসি কখনো কমন ইকুইটি তথা শেয়ার ক্রয় করার মাধ্যমেও অর্থের জোগান দেয়। তবে এর ঋণ পুরো বাণিজ্যিক এবং বাংলাদেশে আইএফসি ভালোই ব্যবসায় করেছে। আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়া মানে, দাতারা ঋণগ্রহিতা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্ট। আইএফসি সনদ না দিলে বাংলাদেশের মতো দেশকে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কোনো ঋণ দেবে না। এসব সংস্থা ঋণ দেয়ার আগে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়। শর্তগুলোর মধ্যে থাকে ম্যাক্রো ইকোনোমিক ম্যানেজমেন্ট সম্বন্ধেই বেশি। ঋণ ক্রেতা দেশের কেমন মুদ্রানীতি হবে, ওই দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বিনিময় হার কেমন হবে, সরকার কতটা ঋণ করতে পারবে, কতটা ভর্তুকি দিতে পারবে এসব নিয়ে আইএমএফ অনেক শর্ত দেয়। এই সংস্থা প্রতিশ্রুত ঋণকে একসাথে কোনো সরকারের আমলে দিয়ে দেয় না। এরা ঋণ ছাড় করে কিস্তিতে। কিস্তিতে ঋণ ছাড় করতে গিয়ে প্রতিশ্রুত শর্তগুলো সরকার পূরণ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখে। না করলে কিস্তি ছাড় করতে দেরি করে, এমনকি বাতিলও করে দেয়। মোট কথা, ছোট অর্থনীতিগুলো বিশ্বের পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে আইএমএফের ভালো নজরে থাকতে হয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিকে ভোট প্রদান করার ক্ষমতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও কিছু ইউরোপীয় দেশ। অন্য সদস্যদেশগুলোর ভোট কম। তাই তারা শুধু বলে। শোনার ব্যাপারটা অনেকটাই নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের এবং তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের ওপর। বাংলাদেশ যে এক বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ ঋণ পেল, তাতে খুশি হওয়ার তেমন কিছু নেই। প্রথমত, এই ঋণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দ্বিতীয়ত, এই ঋণ পেতে হলে সরকারকে অনেক শর্ত মানতে হবে। বলা চলে, আর্থিক এবং রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক আপস করতে হবে। আইএমএফ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি তুলে দেয়ার শর্ত দিলো। এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যে ভোক্তাদের দ্বিগুণ মূল্যে বিদ্যুৎ-গ্যাস কিনতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কোথাও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ শর্ত ছাড়া ঋণ দিয়েছে কি না আমার জনা নেই। আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা যেমন আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)Ñ এদের কাজই হলো ঋণ বিক্রয় করা, অবশ্য ওদের মতে, কনসেশন দেয়া শর্তে। কনসেশন বা ছাড় দুটো ক্ষেত্রে এরা দেয়। সেই দুটো ক্ষেত্র হলোÑ সুদের নিম্ন হার এবং ঋণ ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক বছর সময় দেয়া। এদের ঋণের ‘ভালো’ গ্রাহক হলোÑ দরিদ্র দেশগুলো, উঠতি বা ইমারজিং অর্থনীতির দেশগুলো। এদের থেকে ঋণ নিলেও অনেকটা বাছবিচার করেই নেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো ছোট ও দরিদ্র অর্থনীতির দেশের পক্ষে বাছবিচার করার ক্ষেত্রে ততটা অপশান বা বিকল্প থাকে না।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ব্যক্তি খাতে কোনো ঋণ দেয় না। এরা ঋণ সহায়তা দেয়, তথা ঋণ বিক্রয় করে ঋণের ক্রেতা দেশগুলোর সরকারের কাছে। সে হিসাবে এদের ঋণ ১০০ শতাংশ নিরাপদ। কেন না, আজ হোক কাল হোক এই ঋণ সদস্যদেশগুলো সুদে আসলে ফেরত দেয়। তবে সত্য হলো, এসব দেশ সহজে ঋণের দুষ্ট চক্র থেকে বের হতে পারে না। বরং এক ঋণ ফেরত দেয়ার জন্য আর এক ঋণ গ্রহণ করতে হয়; যেমন আমাদের বাংলাদেশ। এই দেশ স্বাধীনতার পর থেকে গত ৪১ বছরে অনেক বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে এবং শোধও করেছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এখন আমার জানামতে বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে ২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ জমা আছে। এই ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশকে প্রতি বছর ৯০০ মিলিয়ন ডলার সুদ আসলে ফেরত দিতে হচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটি কী দাঁড়াল? সেটা হলোÑ বাংলাদেশ সরকার যদি বিভিন্ন সূত্র থেকে বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ পায়, তার থেকে অর্ধেকেরও বেশি পুনর্বার ডলারে বিদেশী কথিত এসব সাহায্যসংস্থাকে ফেরত দিতে হচ্ছে। বর্তমানে ব্যয় করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের হাতে বৈদেশিক সাহায্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থের তেমন বড় অংশ থাকে না। প্রশ্ন হতে পারে, এসব সূত্র থেকে বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য না পেলে বাংলাদেশ সরকার কি আগে ঋণের সুদ-আসল পরিশোধ করতে পারত না? পারত, তবে কষ্ট হতো এবং অন্য উৎস থেকে দিতে হতো। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে স্থানীয় মুদ্রা, টাকায় ঋণ নিয়ে এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক বা স্থানীয় আর্থিক বাজার থেকে ডলার ক্রয় করে কথিত দাতাদের সে ঋণ পরিশোধ করতে হতো। বিশ্বব্যাংক যে প্রাইভেট সেক্টর তথা ব্যক্তি খাতে ঋণ দেয় না তা নয়। বিশ্বব্যাংকের একটা শাখা বা উইং আছে যেটা আইএফসি নামে পরিচিত। সেই আইএফসি ব্যক্তি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ দিয়ে থাকে। আইএফসি কখনো কমন ইকুইটি তথা শেয়ার ক্রয় করার মাধ্যমেও অর্থের জোগান দেয়। তবে এর ঋণ পুরো বাণিজ্যিক এবং বাংলাদেশে আইএফসি ভালোই ব্যবসায় করেছে। আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়া মানে, দাতারা ঋণগ্রহিতা দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সন্তুষ্ট। আইএফসি সনদ না দিলে বাংলাদেশের মতো দেশকে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক কোনো ঋণ দেবে না। এসব সংস্থা ঋণ দেয়ার আগে অনেক শর্ত জুড়ে দেয়। শর্তগুলোর মধ্যে থাকে ম্যাক্রো ইকোনোমিক ম্যানেজমেন্ট সম্বন্ধেই বেশি। ঋণ ক্রেতা দেশের কেমন মুদ্রানীতি হবে, ওই দেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ বা বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বিনিময় হার কেমন হবে, সরকার কতটা ঋণ করতে পারবে, কতটা ভর্তুকি দিতে পারবে এসব নিয়ে আইএমএফ অনেক শর্ত দেয়। এই সংস্থা প্রতিশ্রুত ঋণকে একসাথে কোনো সরকারের আমলে দিয়ে দেয় না। এরা ঋণ ছাড় করে কিস্তিতে। কিস্তিতে ঋণ ছাড় করতে গিয়ে প্রতিশ্রুত শর্তগুলো সরকার পূরণ করছে কি না, তা খতিয়ে দেখে। না করলে কিস্তি ছাড় করতে দেরি করে, এমনকি বাতিলও করে দেয়। মোট কথা, ছোট অর্থনীতিগুলো বিশ্বের পরিমণ্ডলে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে আইএমএফের ভালো নজরে থাকতে হয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং এডিবিকে ভোট প্রদান করার ক্ষমতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও কিছু ইউরোপীয় দেশ। অন্য সদস্যদেশগুলোর ভোট কম। তাই তারা শুধু বলে। শোনার ব্যাপারটা অনেকটাই নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের এবং তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের ওপর। বাংলাদেশ যে এক বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ ঋণ পেল, তাতে খুশি হওয়ার তেমন কিছু নেই। প্রথমত, এই ঋণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দ্বিতীয়ত, এই ঋণ পেতে হলে সরকারকে অনেক শর্ত মানতে হবে। বলা চলে, আর্থিক এবং রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অনেক আপস করতে হবে। আইএমএফ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি তুলে দেয়ার শর্ত দিলো। এর ফলে কয়েক বছরের মধ্যে ভোক্তাদের দ্বিগুণ মূল্যে বিদ্যুৎ-গ্যাস কিনতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন