রবিবার, ৬ মে, ২০১২

প্রবৃদ্ধিতে এত খরা কেন!

প্রবৃদ্ধিতে এত খরা কেন!



॥ আবু আহমেদ ॥

আমরা অনেকটা আশাবাদী ছিলাম এই ভেবে যে, আমাদের অর্থনীতি শুধু উচ্চ প্রবৃদ্ধিতে প্রবেশ করবে। কিন্তু আমাদের সেই আশায় ছেদ পড়েছে। এখন বাস্তব অবস্থা হলো, আমাদের জাতীয় অর্থনীতি গত এক দশকের গড় প্রবৃদ্ধিকেও ধরে রাখতে পারবে না। অর্থমন্ত্রী যখন গত বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, জিডিপি তথা জাতীয় অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার হবে ৭ শতাংশ, তখন এক দিকে আমরা খুশি হলেও অন্য দিকে শঙ্কার মধ্যে ছিলাম। তা এ কারণে যে, অর্থনীতিতে যে হাওয়া বইছে তাতে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে না এবং ৬.৫ শতাংশ অর্জন করতে পারলেই আমরা খুশি হবো। আমাদের সেই আশঙ্কাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিকে আরো নিচে প্রাক্কলন করছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলেছে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ কিংবা তার থেকে একটু বেশি বা কম হতে পারে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০১১-২০১২ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ শতাংশ হবে বলে দিয়েছে। ৫.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে, আমার জানা মতে, এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে প্রবৃদ্ধি যে ৭ শতাংশ, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে ৬.৫ শতাংশও হবে না, সে ব্যাপারে আমরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছি। প্রবৃদ্ধি আসে বিনিয়োগ থেকে। প্রবৃদ্ধির অন্য উৎস হলো প্রডাকটিভিটি বা উৎপাদনশীলতা। পরের উপাদানটিকে স্থির ধরলে প্রবৃদ্ধির জন্য একক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা উৎস হলো অর্থনীতিতে বিনিয়োগের পরিমাণ। এই বিনিয়োগ দেশের ভেতর থেকে হতে পারে, আবার বাইরের থেকেও হতে পারে। আমাদের অর্থনীতিতে প্রডাকটিভিটির যে অবস্থান তা বিবেচনায় নিয়ে হিসাব করলে দেখা যাবে, ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বিনিয়োগের প্রয়োজন জিডিপির কমপক্ষে ২৮-৩০ শতাংশ। বাংলাদেশের অর্থনীতি কি ওই পরিমাণ বিনিয়োগ পেয়েছে? বরং বিনিয়োগ সূচক সেই জুন, ২০১০-এর পর থেকেই নিম্নমুখী। বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি। এই নীতি আর্থিক বাজারে তারল্যসঙ্কট সৃষ্টি করেছে এবং এর ফলে এখন অর্থনীতিতে সুদের হার গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। যে সুদের হার ছিল ৯-১০ শতাংশ সেই হার এখন দ্বিগুণ। লক্ষণীয় যে, ২০১০ সালের জুন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের নির্দেশে সঙ্কোচনশীল মুদ্রানীতি অনুসরণ করা শুরু করেছে মূল্যস্ফীতি রোধের দোহাই দিয়ে। এখন অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি কমেছে কি না, সেটা ভোক্তারাই ভালো জানেন। আমরা শুধু বলে আসছিলাম, ওই বিনিয়োগবিরোধী মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতিকে শুধু বাড়াতেই থাকবে। আজ আমাদের শঙ্কা শতভাগ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। এখন আইএমএফ বলছে, অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি কমে ৫.৫ শতাংশ হবে। এর দায়ভার আইএমএফকেও নিতে হবে। তবে সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে বড় ব্যর্থতা হলো বাংলাদেশ সরকারের। কেউ কি কোনো দিন শুনেছে বিনিয়োগ কমে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেলে তখন অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান বাড়ে, মূল্যস্ফীতি কমে! এখন যেটা হচ্ছে এবং হবে সেটা হলো, ভুল অর্থনীতি গ্রহণের ফলে অর্থনীতি এক ধরনের মন্দা অবস্থায় অবস্থান করবে। এর অর্থ হলোÑ কম বিনিয়োগ, কম ব্যয় এবং কম ভোগ। সর্বত্রই অর্থনীতিকে ‘কমের’ মধ্যে থাকতে হবে। আইএমএফ তাদের নিজেদের কথা বলবেই। ওগুলো বলা তাদের কাজের শর্তের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু আমাদের থেকে অনেক ছোট ও দুর্বল অর্থনীতিও আইএমএফকে ‘না’ করে দেয়। দুর্ভাগ্য হলো, বাংলাদেশের নেতৃত্ব এতই দুর্বল যে, শুধু এক বিলিয়ন ডলার ঋণের জন্য তাদের ‘কমের’ সবক পেয়েও ‘না’ বলতে পারেনি। কিন্তু সেই এক বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশের প্রয়োজনের তুলনায় কতটুকু? একটা হিসাব হলো এই রকম, বাংলাদেশ রফতানি ও রেমিট্যান্স বাবদ প্রতি বছর ৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করে। তাহলে এক বিলিয়ন মানে এর ভাগ মাত্র। আর শুধু এই জন্য বাংলাদেশকে এত শর্ত মানতে হচ্ছে। মেরুদণ্ড খাড়া করে আমাদের নেতৃত্ব কি বলতে পারত না, আইএমএফ, আমাদের এক বিলিয়ন ডলার চাই বটে; তবে সঙ্কোচনশীল মুদ্রানীতি গ্রহণ করতে পারব না এবং অহরহ ভর্তুকি কমানোর জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বাড়াতেও পারব না। আইএমএফ যদি বাংলাদেশকে প্রকৃত অর্থে সাহায্য করতে চাইত, তাহলে বাংলাদেশ সরকার যে প্রক্রিয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে যাচ্ছে, এতে বাধা দিত। আজ সবাই জানে, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো থেকে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে সরকারকে হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। সেই ভর্তুকির দায়ভার চাপানো হচ্ছে জনগণের ওপর। সেই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্রজেক্টের মালিক কারা? দেশী-বিদেশী ওই ব্যক্তি-উদ্যোক্তারা। ব্যক্তি-উদ্যোক্তারা একচেটিয়া মুনাফার ফাঁদ বসালেও সরকারের যেমন আপত্তি নেই, তেমনি নেই আইএমএফেরও। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষের স্বার্থ এক হলো কী করে? আমরা জানি, ‘আইএমএফ বলবে, কী উৎস থেকে তোমাদের সরকার বিদ্যুৎ কিনবে সে ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। আমরা শুধু ধরব ভর্তুকি দেয়ার নীতিকে এবং তোমাদের ম্যাক্রো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে।’ কিন্তু এ রকম ভূমিকার শিকার হচ্ছে এ দেশের নিম্নমধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণীর ভোক্তারা। অর্থনীতির আসল দায়টা বহন করছে এই দুই শ্রেণীর লোকেরাই। 
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন