॥ আবু আহমেদ ॥
আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকা কিছু ট্যাক্স দিয়ে সাদা করা একটা চলমান সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যতই আমরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে বলি না কেন, বাজেট উপস্থাপন কালে অথবা অর্থ বিলে এই কালোকে সাদা করার পক্ষে কিছু দুর্বল যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী সেই সুযোগকে অব্যাহত রাখার পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ধরনের সুযোগ অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ না কমিয়ে বরং এর উৎসগুলোকে আরো জোরদার করবে। এই সুযোগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কালো টাকার কালো ব্যবহার কখনো কমানো যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। কালো টাকার উৎস কী? বেআইনি লেনদেন, ঘুষ-দুর্নীতি, কমিশন ও দালালি। এসব আয়ের আইনি ভিত্তি নেই; থাকলেও তা অতি দুর্বল। একজন চোরাকারবারি এমনিতেই বেআইনি কাজে লিপ্ত, যদি তার কথিত আয়কে সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বৈধতা দেয়া হয়, তাহলে সমাজে কি চোরাকারবার কমবে? অনেকে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে চোরাই পথে দেশের বাইরে পাঠিয়ে আবার সেই অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে এনে কথিত বিনিয়োগে দেখাচ্ছে, নতুবা সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বা কোনো রকম ট্যাক্স না দিয়েই সেই পাচারকৃত অবৈধ অর্থকে বৈধ আয় হিসেবে দেখাতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উচিত, বিদেশ থেকে আগত অর্থের উৎস তলিয়ে দেখা। ওই অর্থ যদি বিদেশে অর্জিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় ট্যাক্স-ফ্রি হিসাবে বাংলাদেশে ফিরে এসে বিনিয়োগ হিসেবে প্রদর্শিত হবে! এটা ঠিক, অর্থের কোনো সীমানা নেই। বাংলাদেশের ধনীরা এখন অর্থ নিয়ে বিপদে আছেন। তারা বাংলাদেশকে বিনিয়োগ আয়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা মনে করলেও এই দেশকে অর্থ সঞ্চয় করার জন্য নিরাপদ ভাবেন না। ফলে বাংলাদেশে ব্যবসায়িক লাভ অন্য অনেক দেশ থেকে বেশি হলেও সব আয় বাংলাদেশে থাকে না। বাংলাদেশে যদি এ দেশের সব আয় থাকতো তাহলে আমাদের অর্থনীতি বিনিয়োগের জন্য অর্থের অভাবে ভুগত না। অনেকে আবার ঘুষ দেয়াসহ নানা হয়রানির ভয়ে তাদের ব্যবসায়কে এখানে বড় করতে চাচ্ছেন না। তারা ব্যবসায় সম্প্রসারণ করে দুর্নীতির শিকলে আটকা পড়তে চান না। ফলে বাংলাদেশে এখন যে ব্যবসায় হচ্ছে, তা হলো কিছু ধনিকের ব্যবসায় যারা নিছক ব্যবসায়ের খাতিরে সরকারের সাথে অন্তরঙ্গতা বজায় রাখেন। একেবারে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত, বড় ব্যবসায় দেখা যায় না বললেই চলে। সে অর্থে ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। জিজ্ঞেস করলে তারা বলবেন ‘কী করব ভাই, করাপশন চেইনের সাথে সখ্য না রাখলে যে, ব্যবসায়ই করা যাবে না।’ এরা বলেন আমরা করাপশন চেইনকে খুশি রাখি আর সেটা উন্মুক্ত করতে নিজেরাও করাপশন করি।
বাংলাদেশ থেকে যে কত অর্থ বিদেশে যাচ্ছে, তার আনুমানিক হিসাব পাওয়া যেত বাইরে বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন সম্পদের হিসাব নিতে পারলে। আজকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বাংলাদেশীরা যেসব সম্পদের মালিক, তার পেছনে ব্যয়কৃত অর্থের উৎস কী? সেই জন্য বলি, বাংলাদেশী ধনীদের অনেকেই এখন গ্লোবাল সিটিজেন। তাদের একাধিক পাসপোর্টও আছে। সময়ের বেশির ভাগ তারা পার করেন দেশে নয়, বিদেশে। তাদের দোষ দেয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশের সমাজ-পরিবেশ-রাজনীতি তাদের দেশের বাইরে নিরাপত্তা খুঁজতে বাধ্য করেছে।
কালো টাকার উৎস শত ভাগ বন্ধ করা যাবে, তা বলি না। তবে কালো টাকা, যে টাকার উৎস হয় কালো আয়, অথবা আয় বৈধ কিন্তু ট্যাক্স দেয়া হয়নি, অর্থনীতিতে বেশি থেকে আরো বেশি করে এটা সৃষ্টি হতে থাকবে, যদি কালো টাকা ধরার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ নেয়। সাদা করার সুযোগ দিয়ে কোনো অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ কমানো যায়নি। বাংলাদেশ তো গত এক যুগ বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে, কিন্তু এই অর্থের পরিমাণ কমেছে কি? না। কেন কমেনি? কমেনি এই জন্যই যে, ৭.৫-১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়েও কালো টাকার ধনী লোকেরা তাদের অর্থকে সাদা করতে রাজি নন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা কালো টাকা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন। অথচ তাদের থেকে বেশি চিন্তিত আমাদের রাজস্ব বোর্ড। ধরপাকড় না থাকলে কালো টাকার মালিকেরা ১০ শতাংশ ট্যাক্স দেবেন কেন?
আমাদের অবস্থান এ বিষয়ে পরিষ্কার। কালো টাকা ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে সাদা করার বিধান শুধু দুর্নীতিকেই বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় ও অবিচার। তারা কর দিচ্ছেন ২৫ শতাংশ হারে অথচ যারা অপরাধ করেছেন, দুর্নীতি কিংবা আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেসব অসৎ লোককে কেন মাত্র ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে টাকাকে বৈধ করতে দেয়া হবে? একটা সহজ উদাহরণ হলো, ১০ কোটি কালো টাকা সাদা করতে ট্যাক্স দিতে হবে ১০-১৫ লাখ টাকা। আর সৎ ব্যবসায়ী বা ভালো মানুষ ওই পরিমাণ টাকার বিপরীতে ট্যাক্স দিচ্ছেন ২২-২৫ লাখ টাকা। এটা কি ন্যায়সঙ্গত হলো? আমাদের প্রস্তাবÑ এক. কালো টাকার উৎস সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হোক। আয়টা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। দুই. বৈধ আয় হলে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স এবং তার সাথে জরিমানা সাদা করার সেই সুযোগ দেয়া হোক।
কিন্তু কথিত বিনিয়োগের নামে কালো টাকাকে ট্যাক্স ফ্রি করে দিলে সেটাও বড় অন্যায় হবে।
সমাজে ন্যায়বিচার চলে গেলে সৎ মানুষেরাও অসৎ পথে হাঁটতে চেষ্টা করেন, নতুবা নিজেদের গুটিয়ে-সুটিয়ে নেন। সরকার কি কালো টাকাকে বৈধতা দেয়ার নামে সৎ লোকদের প্রতি চরম অন্যায় করছে না?
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের অর্থনীতিতে কালো টাকা কিছু ট্যাক্স দিয়ে সাদা করা একটা চলমান সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যতই আমরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরুদ্ধে বলি না কেন, বাজেট উপস্থাপন কালে অথবা অর্থ বিলে এই কালোকে সাদা করার পক্ষে কিছু দুর্বল যুক্তি দিয়ে অর্থমন্ত্রী সেই সুযোগকে অব্যাহত রাখার পক্ষে সাফাই গেয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই ধরনের সুযোগ অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ না কমিয়ে বরং এর উৎসগুলোকে আরো জোরদার করবে। এই সুযোগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে কালো টাকার কালো ব্যবহার কখনো কমানো যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। কালো টাকার উৎস কী? বেআইনি লেনদেন, ঘুষ-দুর্নীতি, কমিশন ও দালালি। এসব আয়ের আইনি ভিত্তি নেই; থাকলেও তা অতি দুর্বল। একজন চোরাকারবারি এমনিতেই বেআইনি কাজে লিপ্ত, যদি তার কথিত আয়কে সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বৈধতা দেয়া হয়, তাহলে সমাজে কি চোরাকারবার কমবে? অনেকে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থকে চোরাই পথে দেশের বাইরে পাঠিয়ে আবার সেই অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে এনে কথিত বিনিয়োগে দেখাচ্ছে, নতুবা সামান্য ট্যাক্স দিয়ে বা কোনো রকম ট্যাক্স না দিয়েই সেই পাচারকৃত অবৈধ অর্থকে বৈধ আয় হিসেবে দেখাতে সচেষ্ট হয়ে পড়েন। এসব ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের উচিত, বিদেশ থেকে আগত অর্থের উৎস তলিয়ে দেখা। ওই অর্থ যদি বিদেশে অর্জিত না হয়, তাহলে বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় ট্যাক্স-ফ্রি হিসাবে বাংলাদেশে ফিরে এসে বিনিয়োগ হিসেবে প্রদর্শিত হবে! এটা ঠিক, অর্থের কোনো সীমানা নেই। বাংলাদেশের ধনীরা এখন অর্থ নিয়ে বিপদে আছেন। তারা বাংলাদেশকে বিনিয়োগ আয়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা মনে করলেও এই দেশকে অর্থ সঞ্চয় করার জন্য নিরাপদ ভাবেন না। ফলে বাংলাদেশে ব্যবসায়িক লাভ অন্য অনেক দেশ থেকে বেশি হলেও সব আয় বাংলাদেশে থাকে না। বাংলাদেশে যদি এ দেশের সব আয় থাকতো তাহলে আমাদের অর্থনীতি বিনিয়োগের জন্য অর্থের অভাবে ভুগত না। অনেকে আবার ঘুষ দেয়াসহ নানা হয়রানির ভয়ে তাদের ব্যবসায়কে এখানে বড় করতে চাচ্ছেন না। তারা ব্যবসায় সম্প্রসারণ করে দুর্নীতির শিকলে আটকা পড়তে চান না। ফলে বাংলাদেশে এখন যে ব্যবসায় হচ্ছে, তা হলো কিছু ধনিকের ব্যবসায় যারা নিছক ব্যবসায়ের খাতিরে সরকারের সাথে অন্তরঙ্গতা বজায় রাখেন। একেবারে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত, বড় ব্যবসায় দেখা যায় না বললেই চলে। সে অর্থে ব্যবসায়ীরা বিপদে আছেন। জিজ্ঞেস করলে তারা বলবেন ‘কী করব ভাই, করাপশন চেইনের সাথে সখ্য না রাখলে যে, ব্যবসায়ই করা যাবে না।’ এরা বলেন আমরা করাপশন চেইনকে খুশি রাখি আর সেটা উন্মুক্ত করতে নিজেরাও করাপশন করি।
বাংলাদেশ থেকে যে কত অর্থ বিদেশে যাচ্ছে, তার আনুমানিক হিসাব পাওয়া যেত বাইরে বাংলাদেশীদের মালিকানাধীন সম্পদের হিসাব নিতে পারলে। আজকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও দুবাইয়ে বাংলাদেশীরা যেসব সম্পদের মালিক, তার পেছনে ব্যয়কৃত অর্থের উৎস কী? সেই জন্য বলি, বাংলাদেশী ধনীদের অনেকেই এখন গ্লোবাল সিটিজেন। তাদের একাধিক পাসপোর্টও আছে। সময়ের বেশির ভাগ তারা পার করেন দেশে নয়, বিদেশে। তাদের দোষ দেয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশের সমাজ-পরিবেশ-রাজনীতি তাদের দেশের বাইরে নিরাপত্তা খুঁজতে বাধ্য করেছে।
কালো টাকার উৎস শত ভাগ বন্ধ করা যাবে, তা বলি না। তবে কালো টাকা, যে টাকার উৎস হয় কালো আয়, অথবা আয় বৈধ কিন্তু ট্যাক্স দেয়া হয়নি, অর্থনীতিতে বেশি থেকে আরো বেশি করে এটা সৃষ্টি হতে থাকবে, যদি কালো টাকা ধরার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষ নেয়। সাদা করার সুযোগ দিয়ে কোনো অর্থনীতিতে কালো টাকার পরিমাণ কমানো যায়নি। বাংলাদেশ তো গত এক যুগ বিভিন্ন কৌশলে কালো টাকাকে সাদা করার সুযোগ দিয়ে আসছে, কিন্তু এই অর্থের পরিমাণ কমেছে কি? না। কেন কমেনি? কমেনি এই জন্যই যে, ৭.৫-১০ শতাংশ ট্যাক্স দিয়েও কালো টাকার ধনী লোকেরা তাদের অর্থকে সাদা করতে রাজি নন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, তারা কালো টাকা নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন। অথচ তাদের থেকে বেশি চিন্তিত আমাদের রাজস্ব বোর্ড। ধরপাকড় না থাকলে কালো টাকার মালিকেরা ১০ শতাংশ ট্যাক্স দেবেন কেন?
আমাদের অবস্থান এ বিষয়ে পরিষ্কার। কালো টাকা ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে সাদা করার বিধান শুধু দুর্নীতিকেই বাড়িয়ে দেবে। দ্বিতীয়ত, এই সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি অন্যায় ও অবিচার। তারা কর দিচ্ছেন ২৫ শতাংশ হারে অথচ যারা অপরাধ করেছেন, দুর্নীতি কিংবা আইন লঙ্ঘন করেছেন, সেসব অসৎ লোককে কেন মাত্র ১০-১৫ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে টাকাকে বৈধ করতে দেয়া হবে? একটা সহজ উদাহরণ হলো, ১০ কোটি কালো টাকা সাদা করতে ট্যাক্স দিতে হবে ১০-১৫ লাখ টাকা। আর সৎ ব্যবসায়ী বা ভালো মানুষ ওই পরিমাণ টাকার বিপরীতে ট্যাক্স দিচ্ছেন ২২-২৫ লাখ টাকা। এটা কি ন্যায়সঙ্গত হলো? আমাদের প্রস্তাবÑ এক. কালো টাকার উৎস সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হোক। আয়টা অবশ্যই বৈধ হতে হবে। দুই. বৈধ আয় হলে ২৫ শতাংশ ট্যাক্স এবং তার সাথে জরিমানা সাদা করার সেই সুযোগ দেয়া হোক।
কিন্তু কথিত বিনিয়োগের নামে কালো টাকাকে ট্যাক্স ফ্রি করে দিলে সেটাও বড় অন্যায় হবে।
সমাজে ন্যায়বিচার চলে গেলে সৎ মানুষেরাও অসৎ পথে হাঁটতে চেষ্টা করেন, নতুবা নিজেদের গুটিয়ে-সুটিয়ে নেন। সরকার কি কালো টাকাকে বৈধতা দেয়ার নামে সৎ লোকদের প্রতি চরম অন্যায় করছে না?
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়